“বাবা আমি মল্লযুদ্ধে অংশ নিতে চাই।” হুমায়ুন চমৎকার মল্লবিদ এবং সে সেটা জানে। বাবর সায় দিতে সে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বিদায় নেয়। কামরান আর আসকারীকে নিয়ে নীচের প্রাঙ্গনে নেমে এসে বাবর বিশেষভাবে নির্মিত কাঠের মঞ্চের উপর স্থাপিত একটা চেয়ারে আসন গ্রহণ করে।
শাহজাদা মল্লযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। এটা জানাজানি হতে হুমায়ুনকে প্রথম পর্বেই যুদ্ধের জন্য মনোনীত করা হয়। সে আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাকী মোহসীন। হিরাতের অধিবাসী চওড়া আর চটপটে এক মল্লযোদ্ধা। যে নাকি প্রায়শই গর্ব করে বলে থাকে। সে একাই চার পাঁচজনের মহড়া নিতে পারে। মঞ্চের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজ নিজ অভিবাদন জ্ঞাপন করে। দুই জনেরই পা খালি, কোমর পর্যন্ত উন্মুক্ত, এবং পরনে ডোরাকাটা আঁটসাট ব্রীচেস, যা হাঁটুর কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। সাকী মোহসীনের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতচিহ্নযুক্ত, নিরেট স্বাস্থ্য দারুণ আকর্ষক দেখায়। কিন্তু হুমায়ুনকে দেখতে তার চেয়ে দারুণ লাগে। প্রতিপক্ষের চেয়ে অন্তত চার ইঞ্চি লম্বা বুক, পিঠ, পেট, কাঁধ আর বাহুর নিখুঁত তেল চকচকে- পেষল দেহ থরোব্রেড ঘোড়ার মতো সুষমা আর সৌন্দর্য মণ্ডিত। তার কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল পিঠের উপরে লাল কাপড় দিয়ে মোড়ানো।
বাবরের ইঙ্গিতে যুদ্ধ শুরু হয়। দু’জন বৃত্তাকারে পরস্পরকে ঘিরে ঘুরতে থাকে, হুমায়ুন পায়ের গোড়ালীর উপরে ফণা তোলা সাপের মতো দুলতে থাকে। তার চোখ প্রতিপক্ষের উপর স্থির। সহসা সাকী মোহসিন তার দিকে ধেয়ে আসে। হুমায়ুন এক লাফে সরে গিয়ে প্রতিপক্ষের হাটু নিজের পা দিয়ে আকড়ে ধরে তাকে আছড়ে মাটিতে ফেলে দেয়। মুহূর্তের ভিতরে হুমায়ুন তার প্রতিপক্ষের পিঠের উপরে চেপে বসে, একহাতে তার গলা পেচিয়ে ধরে মাথা পেছনের দিকে টানতে থাকে। অন্যহাতে সে প্রতিপক্ষের ডান হাত ধরে সেটা মোচড় দিয়ে প্রায় কাঁধ পর্যন্ত তুলে আনে। সাকী মোহসীনের ঘাম ছুটে যায়, আর তার মুখ ব্যাথায় বিকৃত হয়ে উঠে। “আমি হার মানছি…” সে কোনোমতে দম নিয়ে বলে।
হুমায়ুন পরবর্তী তিনটা লড়াইও জিতে, যার মানে সে প্রতিযোগিতা থেকে অপরাজিতের খেতাব নিয়ে সরে দাঁড়াতে পারে। বাবর আরো কিছুক্ষণ লড়াই দেখে। কিন্তু চোখের পেছনে একটা তীব্র আর দপদপ করতে থাকা ব্যাথা তাকে বেশ কষ্ট দেয়। সে নিজের কামরায় ফিরে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে বলে ঠিক করে। কামরান আর আসকারী তাকে তার কক্ষের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়, কথা দেয় তিনঘণ্টা পরে তারা এসে। তাকে হুমায়ুনের সাথে তাদের নিশানাবাজির প্রতিযোগিতা দেখার জন্য নিয়ে যাবে।
বাবর তার পরিচারকদের আফিম মেশানো দুধ নিয়ে আসতে বলে। সে ধূসর দেখতে মিষ্টি পানীয়টা পান করে এবং বিছানায় পিঠ ঠেকায়। মাথার ব্যাথা কমতে শুরু করলে, সে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ভিতরে স্বপ্নে সে দেখে হুমায়ুন তার শক্তিশালী মার্জিত দেহের সাহায্যে প্রতিযোগীর পরে প্রতিযোগীদের পরাজিত করছে। দেখে সে নিজে আবার তরুণ হয়ে গিয়েছে এবং সবুজ আর হলুদ দণ্ডের ভিতর দিয়ে ঘোড়া দাবড়ে প্রতিযোগিতা জিতছে। প্রথমবার মাহামকে যেমন দেখেছিলো, অবিকল সে রকম রূপে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। আকশির দূর্গে খানজাদাকে মেহেদী রাঙানো খালি পায়ে পোষা বেজীর পেছনে দৌড়াতে দেখে। ওয়াজির খান তাকে ধৈর্যের সাহায্যে শিখাচ্ছে কিভাবে ধনুকে ছিলা পরাতে হয় এবং সবশেষে বাবুরী কাবুলের দূর্গ প্রাসাদের নীচের সমভূমিতে কামান আর ম্যাচলকের কৌশল তাকে দেখাচ্ছে।
বাবর ঘুম ভাঙতে দেখে সূর্যের আলো তখন কামরার জানালার মার্বেলের জাফরি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। সন্ধ্যার আগে নিশানাবাজির প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে না। তাই তার হাতে এখনও প্রচুর সময় আছে। আড়মোড়া ভেঙে সে উঠে পড়ে এবং তার পরিচারক দিনে চারবার পানি বদলে দেয়। যে জেড পাথরের বোলের সেটার গোলাপজল দিয়ে মুখ ধোয়। শীতল পানিতে মুখ ধুতে ভালই লাগে এবং সে টের পায় তার মাথাব্যাথা সেরে গেছে।
সে পাশের অপেক্ষমানের জন্য নির্ধারিত কামরা থেকে মৃদু আলাপের আওয়াজ ভেসে আসতে শুনে। তার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটাবার জন্য চাপা স্বরে কথা বলছে। পর্দার কাছে গিয়ে সে সেটা সরাতে যাবে কিন্তু ওপাশে কথাবার্তা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে। নিশ্চিতভাবে কামরানের গলা সে শুনতে পায়। সে যদিও চাপা স্বরে কথা বলছে, কিন্তু তার মন্ত্র, উল্লসিত আওয়াজ কোনোমতেই ভুল হবার নয়।
“সাকী মোহসীন একটা আহাম্মক। আমি তাকে কতোবার বলেছিলাম হুমায়ুনকে মল্লযুদ্ধে হারাতে হলে বলদের মতো তার দিকে কখনও ধেয়ে যাবে না- হুমায়ুন অনেক বেশি চটপটে। হুমায়ুনের প্রথম আক্রমণের জন্য তার অপেক্ষা করা উচিত ছিলো। তাহলে আমরা একটা দারুণ লড়াই দেখতে পেতাম। হুমায়ুন চিত হয়ে পাছার উপরে ভর দিয়ে পড়ে আছে দেখতে পেলেও শান্তি… কিংবা তারচেয়েও ভালো লাগতো যদি ওর পাঁজরের হাড় ভাঙার আওয়াজ শুনতে পেতাম…’
“নিশানাবাজির প্রতিযোগিতার কি হবে?” ভাইয়ের চেয়ে উচ্চকণ্ঠে আসকারি এবার কথা বলে এবং তার কণ্ঠস্বর সামান্য উদ্বিগ্ন শোনায়। “সেই কি জিতবে নাকি আমাদের কোনো সুযোগ আছে?”