বাবর মৃদু হাসে। “আমাদের নিয়তির প্রতি তোমার বিশ্বাস দেখে আমি প্রীত হয়েছি। আমি অন্য কিছু আশাও করিনি। কিন্তু বেহেশতে সবকিছু নির্ধারিত হয় না। সে কি বলেছিল যে বুয়া আমাকে বিষপ্রয়োগের চেষ্টা করবে? আর তাছাড়া নতুন ভূখণ্ড দখলে। রাখতে হলে আমাদের নমনীয় আর দক্ষতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে হবে। নেতৃত্ব আর একাগ্রতা এক্ষেত্রে তারকারাজির চেয়ে বেশি সাহায্য করবে…আমার রোজনামচার এই অনুচ্ছেদটা পড়ে দেখো…” বাবর ছেলের হাত থেকে প্রতিলিপিটা নিয়ে দ্রুত একটা পাতা খুঁজে বের করে: “একজন শাসককে সবসময়ে সতর্ক থাকতে হবে, তার অমাত্যদের কথা শুনতে হবে এবং বিশ্বাসঘাতকতা যে কোনো ঘটনা কঠোর হাতে দমন করতে হবে।”
“মনে রেখো, হুমায়ুন, শাসকের দায়িত্বের চেয়ে বড়ো দাসত্ব আর হতে পারে না। আমার ছেলে হিসাবে- এটা মনে রেখো- সব সময়ে সবাই তোমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। একাকী এতো সময় কাটানোটাকে তোমার দুর্বলতা হিসাবে বিবেচনা করা হবে। আমরা খোলাখুলি আলোচনা করি। আমি জানি তোমার মনে কি ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। কারণ, তোমার মুখে আমি সেই ছায়া সবসময়ে দেখতে পাচ্ছি। তুমি জানতে চাও আমি তোমাকে আমার উত্তরাধিকারী মনোনীত করবো কিনা। আমার উত্তর হলো আমি এখনও সেটা ঠিক করতে পারিনি…এখন পর্যন্ত আমি সিদ্ধান্ত নেইনি। তোমার সাহসিকতা নিয়ে আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু আমাকে দেখতে হবে নেতৃত্ব, দূরদৃষ্টি, একাগ্রতা আর দক্ষতার মতো মানসিক বৈশিষ্ট্য তোমার রয়েছে …আমার রক্তের মতো তোমার রক্তেও তৈমূর আর চেঙ্গিসের রক্তের তেজ আর নিষ্ঠা প্রবাহিত হচ্ছে, আমার কাছে সেটা প্রমাণ করো…”
*
“সুলতান, ঘোড়দৌড়ের প্রথম হিট এখন অনুষ্ঠিত হবে।”
আগ্রা দূর্গের ছাদের প্রাকারে দাঁড়িয়ে নদীর তীর বরাবর হলুদ আর সবুজ নিশান পোতা দেখতে পায়, যেখান থেকে ঘোড়দৌড় শুরু হবে। ছয় সারিতে দশ ফিট পর পর লাঠি পোতা হয়েছে। যা চারশ গজ পর্যন্ত বিস্তৃত– ঘোড়দৌড়ের সীমানা। প্রতিযোগীদের একেঁবেঁকে এর ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে এবং শেষ প্রান্তে শেষ লাঠির আট ফিট পরে মাটিতে রাখা ভেড়ার কাটা মাথা বর্শার ডগায় গেথে তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে ঘুরে আবার একই পথে ফিরে আসতে হবে। বাঁক নেয়াটাই সবচেয়ে কঠিন আর দক্ষতা এবং ঠাণ্ডামাথা দরকার হবে দ্রুত বাঁক নিতে।
হিন্দুস্তানে বাবরের আগমনে চতুর্থ বার্ষিকী উদযাপনের জন্য তিনদিন ব্যাপী উৎসবের অংশ প্রতিযোগিতাটা। পরে মল্লযুদ্ধের আয়োজন করা হবে। তারপরে তার তিন ছেলের ভিতরে নিশানভেদের প্রতিযোগিতা হবে: বাবর সম্প্রতি তার দেহরক্ষীর কাছ থেকে একটা উন্নত মাস্কেট ক্রয় করেছে। সেটা দিয়ে যে প্রথমে মাটির ভাণ্ডে গুলি লাগাতে পারবে, সে একটা পান্নার আংটি পাবে। আংটির পাথরে তৈমূরের জন্মের সময়ে তারকারাজির কল্পিত অবস্থান বোঝাতে ব্যবহৃত তিনটা পরস্পর সংযুক্ত বৃত্ত খোদাই করা রয়েছে, যা বাবর তার নতুন সাম্রাজ্যের প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করেছে।
হুমায়ুন, আসকারী আর কামরান, বাবরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের কেউ ঘোড়দৌড়ে অংশ নিলে অনায়াসে জয়লাভ করতো। কিন্তু আজকের দৌড় কেবল বাবরের সেনাপতিদের জন্য নির্ধারিত। নিজেদের সম্রাটের কাছে আপন আপন যোগ্যতা প্রমাণের এটাই সুযোগ। পুরষ্কার হিসাবে রয়েছে সোনার কারুকাজ করা পর্যানে সজ্জিত একটা বিশাল সাদা স্ট্যালিয়ন এবং লাগামটা খাঁটি সোনার পাত দিয়ে মোড়া।
বাবা ইয়াসাভাল, সম্প্রতি তাকে বাবরের অশ্বশালার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দৌড় শুরুর স্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শনার্থীদের ভিড়ে তাকে প্রায় দেখাই যায় না। সবাই ভালো করে দেখার জন্য নিজেদের ভেতরে গুতোগুতি করছে। সে তার হাতে ধরা বর্শা উঁচু করতে ধরতে প্রথম ছয়জন প্রতিযোগী এগিয়ে আসে। বাবরের দিকে তাকালে, সে ইশারায় শুরু করার ইঙ্গিত দিলে, ইয়াসাভাল হাতের বর্শা নামিয়ে নেয়। প্রতিযোগীরা তীব্র বেগে ঘোড়া ছোটায়। ঘোড়ার গলার প্রায় সমান্তরালে শুয়ে তারা কাঠের দণ্ডের ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে ঘোড়া দাবড়ায়। বাবরের, কিশোর বয়সে ভেড়ার মাথা নিয়ে পোলো খেলার কথা মনে পড়ে এবং নস্টালজিয়ার একটা রাশ তাকে আপ্লুত করে।
প্রতিযোগীরা দণ্ডের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে এবং হাতের বর্শা নীচু করেছে। প্রথমে এগিয়ে থাকা অশ্বারোহী- ধূসর দাড়িশোভিত তাজিক, হাসান হিজারী- বর্শার মাথায় নিপূনভাবে ভেড়ার মাথাটা গেঁথে নিয়ে নিখুঁতভাবে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তার ঠিক পেছনের অশ্বারোহী তার মতো পারদর্শী না। তার বর্শার ডগা লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হয় এবং মাটিতে বিদ্ধ হয়, এবং দর্শকদের আমোদিত করে তাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে তুলে নিয়ে বনবন করে পাক খাইয়ে পশ্চাদদেশের উপরে মাটিতে আছড়ে ফেলে। বাকি চারজন নিরাপদে ঘোড়া ঘুরিয়ে নেয়। একজন বাদে সবাই নিশানা ভেদ করতে পেরেছে।
প্রায় এক ঘণ্টা পরে বাকি পাঁচটা হিট শেষ হয় এবং বিজয়ীরা আবার পরস্পরের সাথে দৌড়াতে একজন বিজয়ী হিসাবে আবির্ভূত হয়। আর সে হাসান হিজারী না। বাবর যেমনটা ভেবেছিলো বরং কাবুলের এক তরুণ যোদ্ধা। সে তার বাদামী রঙের মাদী ঘোড়াটাকে বিদ্যুচ্চমকের মতো দাবড়েছে। আজ রাতে আয়োজিত ভোজসভায় বাবর তাকে পুরস্কৃত করবে। লাঠিগুলো এবার তুলে ফেলা হয় এবং বাবরের লোকের দৃর্গের দিকে তাড়াতাড়ি রওয়ানা দেয় মল্লযুদ্ধ দেখার জন্য। যেখানে দূর্গের প্রধান আঙ্গিনায় পাথরের মেঝের উপরে কয়েক পরত গালিচা পাতা হয়েছে।