একটাই বাঁচোয়া, দশ বছরের হিন্দাল ভাইদের ভিতরের এইসব প্রতিযোগিতার মাঝে নেই। মাহাম এখনও তাকে কাছে কাছেই রাখে। যদিও বাবর শীঘ্রই তার জন্য একজন শিক্ষক নিয়োগ করবে। হিন্দালের জন্মদাত্রী-মা, দিলবার আগ্রা আসেনি। সে অসুস্থ, আর কাবুলে হিন্দালের বোন গুলবদনের সাথে অবস্থান করছে। সে সুস্থ হয়ে উঠলে বাবর তাকে নিয়ে আসবার জন্য লোক পাঠাবে। আর তাহলে তার পুরো পরিবার আবার তার পাশে থাকবে। ঠিক যেমনটা হবার কথা।
বাবর উঠে দাঁড়ায়। আবার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গঙ্গার পানির ভিতর দিয়ে শক্তিশালী ভঙ্গিতে সাঁতার কেটে এগিয়ে যায়। এবার কেবল ত্রিশটা স্ট্রোক প্রয়োজন হয়- যেখানে তার লোকেরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে।
*
“আমি চাই তুমি এটা নাও।” বাবর তার রোজনামচার একটা প্রতিলিপি হাতির দাঁতের নকশা করা মলাট দিয়ে বাঁধানো এগিয়ে দেয়। “আমার জীবনের কথা এখানে লেখা আছে, যা বহু বছর ধরে আমি লিখে আসছি এবং ভবিষ্যতেও লিখে যাবো। আমি আমার অনুলিপিকারীকে আদেশ দিয়েছি প্রতিলিপি তৈরি করার জন্য…”
হুমায়ুন হাত বাড়িয়ে রোজনামচাটা নেয়। তার বাদামী চোখ- অবিকল মাহামের মতো- বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে উঠেছে। “আব্বাজান এটা একটা বিশাল সম্মানের বিষয়।”
“তারচেয়েও বড় কথা, আমি আশা করবো তুমি এটা পড়ে শিক্ষা নেবে। অভিযান আর যুদ্ধটা তুমি ভালোই বোঝে। কিন্তু আমি যে অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে গিয়েছি সেসব সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই… তোমার চেয়ে অর্ধেক যখন আমার বয়স, তখন আমি সুলতানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হই। আমি আজও বেঁচে আছি আমি আমার গুটিকয় লোকের আনুগত্য, আমার আম্মিজান আর নানীজানের বিচক্ষণতা আর আমার উপস্থিত বুদ্ধির জোরে। একটা সময় ছিলো, যখন আমার কিছুই ছিলো না এবং একপাত্র মাংসের সুরা দেখে আমার চোখে খুশির বান ডাকতো…সেসব ছিলো নিরানন্দ দিন। কিন্তু আমাকে সাম্রাজ্য শাসনের জন্য দক্ষ আর যোগ্য করে তুলেছে আমার প্রতিজ্ঞাকে দৃঢ়তা দিয়েছে যে, আমি একটা সাম্রাজ্য গঠন করবোই… অনেকবেশি নিরাপত্তার মাঝে তুমি বেড়ে উঠেছে। তোমাকে দেখে রাখার জন্য তুমি তোমার পিতাকে পেয়েছো, ভাইদের পেয়েছো কৈশোরের উজ্জ্বলতা ভাগ করে নেবার জন্য…তোমার উচিত এসবের গুরুত্ব দেয়া…”
“আমি দেই আব্বাজান।” হুমায়ুনকে বিভ্রান্ত দেখায়।
বাবর চোখ সরিয়ে নেয়। ব্যাপারটা কঠিন। সে তার এই লম্বাচওড়া, পেশীবহুল ছেলেটাকে নিয়ে গর্বিত, যে নিজের সাহসিকতা আর দক্ষতার বেশ ভালোই পরিচয় দিয়েছে।
“ভাইদের প্রতি তোমার আচরণ কেমন উন্নাসিকতাপূর্ণ। কামরান তোমার চেয়ে মাত্র কয়েকমাসের ছোট। হিন্দুস্তান অভিযানে সে অংশ নেয়নি, এতে তার কোনো দোষ নেই। সে কাবুলে নিজের দায়িত্ব পালন করেছে, বেশ ভালোমত পালন করেছে। কিন্তু তারপরেও তুমি তার উপরে ছড়ি ঘোরাতে চেষ্টা করছে। তুমি আসকারীর সাথে একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো আচরণ, যা সে আর নেই এবং সে এটা নিয়ে ক্ষিপ্ত। তোমাদের মাঝে সামান্য প্রতিযোগিতা স্বাস্থ্যকর, কিন্তু ভাইদের প্রতি তোমার আরও সহনশীল হওয়া উচিত…”
হুমায়ুন কোনো উত্তর দেয় না।
“এই নতুন ভূখণ্ডে আমাদের শক্তিই হলো আমাদের একতা। নতুবা আমাদের পতন ঘটবে। ভাইদের সাথে আরও সময় কাটাও, তুমি শিখেছো এমন কিছু তাদের সাথে ভাগ করে নাও…তুমি অনেকদিন একাকী কাটিয়েছে। অনেকদিন সন্ধ্যাবেলা আমি তোমাকে ডেকে পাঠালে জানতে পারতাম তুমি ঘোড়া নিয়ে একাকী বের হয়েছে…তোমার অনেক সেনাপতিও আমাকে অভিযোগ করেছে তোমার কাছে পরামর্শ চাইতে গিয়ে বা কোনো খবর জানাতে গিয়েও তারা তোমাকে পায়নি। এই একাকীত্বের কি প্রয়োজন?”
“আমি নির্বিঘ্নে একটু চিন্তা করার সুযোগ চেয়েছিলাম…নিজেকে আর নিজের চারপাশের এই পৃথিবী সম্পর্কে বোঝার জন্য। এসবের কি মানে, কেন আমাদের জন্ম হয়েছে…আমি বিশেষ করে বেহেশতের ধারণা বোঝার চেষ্টা করতাম। আর সেজন্যই আমি সন্ধ্যাবেলা আর রাতে একাকী বের হয়ে যেতাম।”
“আর তারার দিকে তাকিয়ে তোমার কি বোধোদয় হয়েছে?”
“আল্লাহতালার ইশারায় তারকারাজি আমাদের নিয়তি নির্ধারণ করে। আপনি আমাকে প্রায়ই তুষারাবৃত পাহাড়ের চূড়ার উপরে ক্যানোপাসকে জ্বলজ্বল করতে দেখার কথা বলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন সেটা একটা আলামত…?”
“আমি বিশ্বাস করি আল্লাহতালার মর্জি তারার মাঝে ফুটে উঠে। কিন্তু আমি এটাও বিশ্বাস করি যে, মানুষের নিজের ভাগ্য গড়ে নেবার সাধ্য রয়েছে। বেহেশতে সম্ভাব্য। পরিণামের ইঙ্গিত থাকে। কিন্তু সিদ্ধান্ত, পছন্দ করার দায়িত্ব আমাদের…” বাবরের কণ্ঠস্বর একটু বেশি কড়া শোনায়। কারণ হুমায়ুনকে দেখে সে বুঝতে পারে বেটার মাথায় তার কথা ঠিকমতো প্রবেশ করছে না।
“আব্বাজান, আমি আপনাকে কখনও বলিনি, কিন্তু পানিপথে লড়াইয়ের আগের রাতে আমার ব্যাক্তিগত জ্যোতিষ আমাকে বলেছিলো পরের দিন ঠিক দুপুর বেলা আকাশে যদি তিনটা বাজপাখি যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা যায়, আমরা একটা বিশাল বিজয় অর্জন করবো। ধূলো আর যুদ্ধের ডামাডোলের মাঝে, আমি আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাই, কামার আর মাস্কেটের ধোঁয়ার উপরে আমি আমাদের মাথার উপরে তিনটা বাজপাখিকে নিশ্চল হয়ে ভেসে থাকতে দেখি। এখানেই শেষ না। আমার সেই জ্যোতিষি হিন্দুস্তানে মোঘলদের বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন…এজন্যই আমি তারকারাজির দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করতাম পরবর্তীতে কি ঘটতে চলেছে।”