রাতের বেলা সে অধিক আগ্রহের সাথে রোজনামচা লিখতে বসে। কৃষকদের মাঠে চাষ করার বিবরণ থেকে দেউতির দল, যারা তাদের লাউয়ের খোলসের পাত্রে ভর্তি তেল আর ধাতব তেপায়ায় সংযুক্ত মোটা সলতে দিয়ে শহর আর গ্রামের রাস্তায় আলো জ্বেলে বেড়ায়, সবকিছুই সে লিখে রাখে। সে যেসব প্রাণী তার কাছে নতুন দেখছে বলে মনে হয়, তার বর্ণনা লিখতে চেষ্টা, যেমন আনন্দোচ্ছল, লাফাতে পছন্দ করা নদীর শুশুক, হিন্দুস্তানের সব নদীতে এদের দেখা যায়। চোয়াল কুমীরের চোয়ালের মতো।
শীঘ্রই সে আগ্রায় ফিরে যাবে, যেখানের উদ্যানে তার লাগানো গাছগুলো বেড়ে উঠেছে এবং প্রথমবারের মতো কাবুল থেকে আগত মালীর দল আঙুর আর তরমুজ ফলিয়েছে। এছাড়া সাতশ হিন্দুস্তানী পাথরের কারিগর আগ্রায় রানা সঙ্ককে পরাস্ত করার খুশিতে যে মসজিদ নির্মাণ শুরু করেছে, সেটা নির্মাণে ব্যস্ত রয়েছে। মসজিদের উঁচু কুলুঙ্গিযুক্ত খিলান- ইউয়ান- মার্জিত ভঙ্গিতে ক্রমশ সরু হয়ে উঠে যাওয়া মিনার এবং তার প্রিয় ফুলের উদগত শিল্পকর্ম হিন্দুস্তানী কারিগরের দল এতোটাই নিখুঁতভাবে টিউলিপ আর আইসিস এঁকেছে, যে মনে হবে বাতাসের ঝোকায় পেলব ফুলগুলি বুঝি এখন মাথা নেড়ে উঠবে-একটা সুন্দর ভবন নির্মিত হতে চলেছে। সে আগ্রা আর কাবুলের ভিতরে চিঠি চালাচালির একটা ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে। প্রতি আঠার মাইল পরে পরে বিশ্রামের স্থান যুক্ত করা হয়েছে। পূর্বেই ভাড়া করা ঘোড়ার বহর আর তার চালককে সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত রাখা হয়। যাতে চিঠিপত্রগুলো হিন্দুস্তানে বাবরের রাজধানী এবং খাইবার গিরিপথের ওপাশে তার ভূখণ্ডে দ্রুত চিঠিপত্র আনা নেয়া করা যায়।
এতো কিছু অর্জিত হবার কারণে, আজকাল তার রোজনামচার আগের পাতাগুলো পুনরায় পড়ে দেখতে ভালোই লাগে, বিশেষ করে সালতানাহীন, আশাহীন অবস্থা এবং সমরকন্দের প্রতি দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা থেকে লেখা হতাশ বিষণ্ণ বিলাপধ্বনি। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। সে তৈমূরের শহর এতোদিন দখল করে রাখতে পারেনি যাতে সেখানে স্থায়ী কিছু তৈরি করতে পারে। হিন্দুস্তানে সে টেকসই ইমারত তৈরিতে হাত দিয়েছে। মৃত্যুর সময়ে, আল্লাহ সহায় থাকলে সে তার সন্তানদের জন্য একটা সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যই রেখে যাবে।
বাবর উঠে বসে পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা সবুজ কাঠঠোকরা ঝোপঝাড়ের মাঝে ছোঁ দিতে তার ডানায় সূর্যের আলো পড়ে পান্নার রঙ ঝলসে উঠে। তার ছেলেদের ব্যাপারে কি করা যায়? বাবর মাহাম, গুলরুখ, খানজাদা, তাদের চাচী, কামরান, আকসারী আর হিন্দালের জন্য নিরাপদ ভেবে এখন তাদের আনতে লোক পাঠিয়েছে। অচিরেই তারা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে থেকে আগ্রায় উপস্থিত হবে। তাদের আগমন উপলক্ষে সে বিশাল এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলো এবং তার বড় দুই ছেলেকে চারকোব, ইয়াকের লেজের স্মারক, জয়ঢ়াক, উৎকৃষ্ট ঘোড়া, দশটা করে হাতি এবং অসংখ্য উট, খচ্চর দান করেছে।
সে তাদের পিতা হিসাবে গর্বিত। খানজাদা তাকে বলেছে যে, কামরান-এখন তার বিশ বছর বয়স এবং মুখে দাড়ি দেখা দিয়েছে তার আর বাইসানগারের কথামতো কাবুল ভালোই শাসন করেছে। বাইসানগার বহুদিন সেখানের রাজপ্রতিভূ হিসাবে দায়িত্বরত ছিলো। তেরো বছরের আসকারীও নিজের যোগ্যতা আর উচ্চাশার পরিচয় দিতে শুরু করেছে। আর কেনো হবে না? বাবর এই বয়সে ফারগানার সুলতান হয়েছিলো। তারা এসে পৌঁছাবার পরে বাবর তাদের উপযোগীতা ভরপুর ব্যবহার করছে। নিয়মিতভাবে এলাকা পরিদর্শনে আর বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহ দমন করতে পাঠিয়েছে।
তাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। কিন্তু হুমায়ুনের প্রতি তাদের আচরণ- বিশেষ করে কামরানের- দেখে বাবর মাঝে মাঝে মর্মাহত হয়। তাদের ক্ষুব্ধ এমনকি ঈর্ষান্বিত মনে হয়। কিন্তু এটাই স্বাভাবিক, সে নিজেকে বোঝাতে চায়। হিন্দুস্তান অভিযানে পুরোটা সময় হুমায়ুন বাবরের সাথে ছিলো। হুমায়ুন আর তার মাঝে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেখে কামরান, বয়সে যে হুমায়ুনের প্রায় সমবয়সী তার নিজেকে বঞ্চিত মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। বাবর বিষয়টা নিয়ে খানজাদার সাথে আলোচনা করেছে। তার পরামর্শ ছিলো, সে যেনো হুমায়ুনকে বলে নিজের ভাইদের সাথে একটু কুশলী আচরণ করে।
মাহামের চোখেও ব্যাপারটা ধরা পড়েছে এবং সে কামরান আর আসকারীর মা গুলরুখকে দোষী করেছে নিজের ছেলেদের হুমায়ুনের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার জন্য। হুমায়ুনকে তার ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী ঘোষণা করার জন্য মাহামের অনুরোধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু কেবল সে নিজেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা রাখে। এবং সে নিজেকে যখন এ ব্যাপারে প্রস্তুত মনে করবে। নিজের ছেলেদের ভেতর থেকে নিজের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী মনোনীত করার ব্যাপারটা রাজার অধিকারভুক্ত বাস্তবিকপক্ষে, প্রাচীনকালে তারা এজন্য পরস্পরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে বলে আশা করা হতো…কেবল সবচেয়ে শক্তিমানকে মনোনীত করা হতো। কারণ সেই নিজের গোত্রকে রক্ষা করতে পারবে। নিঃসন্দেহে হুমায়ুন ভালো যোদ্ধা, কিন্তু আজকাল একজন রাজাকে আনুগত্য অর্জন আর মিত্র তৈরির মতো গুণাবলীও প্রদর্শন করতে হয় সমরদক্ষতার পাশাপাশি। কোনো চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার আগে বাবর নিজের মনে সন্দেহের কোনো অবকাশ রাখতে চায় না।