*
সেদিন সন্ধ্যাবেলা হুমায়ুন তার আব্বাজানের বিশাল লাল রঙের যুদ্ধের জন্য নির্ধারিত তাঁবু যেখানে তার ব্যক্তিগত কামরা অবস্থিত সেখানে প্রবেশ করে। যুদ্ধের স্মৃতি এখন তার মনে তাজা এবং নতুন সাম্রাজ্যে নিজের অবস্থান সম্পর্কে তার মনে উৎকণ্ঠা জন্ম নিয়েছে। তার উচিত আব্বাজানের উত্তরাধিকারী হওয়া। কারণ সে বড় ছেলে- যদিও তৈমূরীয় প্রথা অনুযায়ী বড় ছেলে সবসময়ে অধিকার বলে উত্তরাধিকারী হয় না এবং বাবরের প্রিয় স্ত্রীর সন্তান। এখন যুদ্ধক্ষেত্রেও সে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। এখন হয়তো সময় হয়েছে আব্বাজানের সাথে উত্তরাধিকারীর বিষয়ে আলাপ করার। নিদেনপক্ষে নতুন কোনো দায়িত্ব যেখানে সে নিজের যোগ্যতা আরও প্রমাণ করতে পারবে।
বাবরের কামরার সোনার কারুকাজ করা ভারী পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে সে। দেখে তার পিতা একটা নিচু ডিভানে সোনার কারুকাজ বেগুনী আর সাদা তাকিয়ায়। মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। আর পাশেই একটা রূপার হুঁকো রাখা। হুমায়ূনের ভেতরে প্রবেশের শব্দ বা তাকে সে দেখতে পেয়েছে বলে মনে হয় না। ভাবলেশহীন চোখে সে তাকিয়েই থাকে। হুমায়ূন কাছে এসে দেখে বাবরের চোখের তারায় দৃষ্টিহীন অভিব্যক্তি এবং তার সবুজ চোখের মণি প্রসারিত হয়ে আছে। সে বাবরের কাঁধে হাত রেখে আলতো করে তাকে একটা ঝাঁকি দিলে তার চোখের পাতা পিটপিট করে উঠে এবং সেখানে ভাষা ফিরে আসে। “হুমায়ুন বেটা, তুমি কখন এলে?”
“কিছুক্ষণ আগে।”
“রাতের আহারের পরে আমি ভাঙ আর আফিম মিশ্রিত একটা হুঁকো টেনে থাকি, যা আমাকে এই পোড়া মাটির দেশ আর এর অসংখ্য মানুষের ভীড় থেকে আর সব ধরণের বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। আমি আবার ফারগানার পার্বত্য এলাকায় ফিরে যাই। পান্নার মতো সবুজ ঘাসের দোলা, যার মাঝে মাঝে লাল টিউলিপ আর নীল আইরিস ফুটে আছে। আমি চঞ্চল নহরের স্বচ্ছ আর ঝকঝকে পানির ধারা বইতে দেখি- প্রতিটা ফোঁটায় একটা পৃথিবী ধারণ করে আছে। আমি আবারও তরুণ বয়সের মতো নির্ভার, আর বেপরোয়া হয়ে উঠি। আমার উপরে যেনো শান্তির বারিধারা বর্ষিত হয় এবং আমাকে সব ধরনের দায়িত্ব আর দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেয়। বাবর প্রশান্তিতে হাসে, সামান্য ক্লান্তির ছোঁয়া রয়েছে তার হাসিতে। “তুমি কি বলো? আমরা কি গোলাপপানির গন্ধযুক্ত সেই অসাধারণ মিষ্টি আরেকবার খেয়ে দেখবো?”
হুমায়ূন বুঝতে পারে তার স্বপ্নের কথা আলোচনার সময় এটা না। তার আব্বাজান এখন অতীত রোমন্থন করছেন। তারও হয়তো তাই করা উচিত। গজনীর লাল মদ আসলেও দারুণ। পুনরায় পান শুরু করার জন্য তাকে অন্তত বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। আমি কেবল বলতে এসেছিলাম আগামীকাল আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে আর অবশ্যই শুভরাত্রি জানাতে।” তাঁবু থেকে বের হয়ে এসে বাবর তারকা খচিত রাতের আকাশের দিকে তাকায়। সে তাকিয়ে থাকলে বেহেশতের অন্যবদ্য নকশার জন্ম দিয়ে আরো তারা ফুটে উঠে। সহসা শিবিরের কোলাহল, মানুষ আর পশুর হাঁকডাক, আগুনের শিখার উজ্জ্বলতা আকাশের স্বর্গীর আলোর কাছে যাকে স্থূল মনে হয় তাকে অস্থির করে তোলে। সে তার ঘোড়া নিয়ে আসতে বলে এবং নিরবে তারা নিচে অন্ধকারে একাকী ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে যাবে বলে ঘোড়ায় চেপে বসে।
৪.৭ রাজত্বের দায়ভার
২৬. রাজত্বের দায়ভার
গঙ্গার পানি বেশ উষ্ণ এবং বাবর তেত্রিশ স্ট্রোকে বেশ আনন্দেই নদীটা অতিক্রম করে। তার শপথের শেষ অংশ পালন করতে পেরে নিজেকে তার হাল্কা মনে হয়। ছয় বছর আগে বাবুরীকে নিয়ে বরফশীতল সিন্ধু নদে সে ঝাঁপ দিয়েছিলো এবং সেদিনই মনে মনে পণ করেছিলো তার নতুন সাম্রাজ্যের সব প্রধান নদী সে সাঁতরে অতিক্রম করবে। চোখ আর চুল থেকে পানির ফোঁটা ঝেড়ে ফেলে বাবর তীরে উঠে এসে সূর্যের নীচে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। নদীর অপর তীরে একটা ঝাকড়া নিম গাছের নীচে সবুজ ঘাসের বুকে আগ্রা থেকে দেড়শ মাইল দূরে, কনৌজের কাছে অবস্থিত শিবির থেকে তার সাথে আগত দেহরক্ষী আর শিকারীর দল ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করে। আজ রাতে অন্ধকার হলে সে আর তার লোকেরা পানির উপরে মোমবাতি ধরে মাছ মারতে যাবে। কোনো একটা অজানা কারণে ঝকঝকে আলোর মোহ মাছ কোনোমতেই এড়াতে পারে না, তাদের পানির উপরে তুলে আনে, যেখানে সহজেই তখন তাদের হাত দিয়ে ধরা যায়।
বাবর চোখ বন্ধ করে নদীটার কথা ভাবে। তার আদেশে বিদগ্ধজনেরা হিন্দুস্তানের যে মানচিত্র অংকন করেছে, সেখানে গঙ্গা পূর্বদিক থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলা মুলুকের উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে বিশাল নীল সাগরে পতিত হয়েছে। একদিন বাবর নিজেকে প্রতিশ্রুতি দেয়, সে পানির বিশাল ঝকঝকে বিস্তার দেখতে যাবে, সে পুরো ব্যাপারটা ঠিকমতো কল্পনাই করতে পারে না… কেমন দেখতে সেটা, যেখানে পানির বুকে দিগন্ত নেমে এসেছে?
হিন্দুস্তান এখন তার কাছে বিস্ময়কর, বিভ্রান্তকর একটা স্থানের নাম। তার মাতৃভূমির সাথে তুলনা করলে এটা আসলেও যেনো ভিন্ন একটা জগৎ। এখানের পর্বত, নদী, বনাঞ্চল আর জনহীন প্রান্তর, এখানকার গ্রাম আর পরগনা, এর প্রাণী আর গাছগাছালি, মানুষ আর তাদের ভাষা, এমনকি বৃষ্টি আর বাতাসও একেবারেই আলাদা…কিন্তু সে যখন প্রথমবার সিন্ধু অতিক্রম করেছিলো, তখন সে হিন্দুস্তানকে অপরিচিত এমনকি নিপীড়ক বলে ভেবেছিলো। আর এখন সে এই জায়গাটা আদতেই উপভোগ করতে শুরু করেছে। রানা শঙ্ককে পরাজিত করার পরে থেকে, বেশিরভাগ সময়ই তার ভ্রমণ করে বেটেছে। ছোটখাট একটা শহরের আদলে তৈরি করা বিশাল সব শিবিরে, তার লাল তাবুটা সেইসব শিবিরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত- সমরকন্দ থেকে তৈমূর। যেমন একদা পরিদর্শনে বের হতেন। এইসব ভ্রমণের ফলে বাবর সুযোগ পেয়েছে নিজেকে প্রজাদের সামনে উপস্থাপনের, কিন্তু একই সাথে সে জানবার সুযোগও পেয়েছে।