“একটা কাপড় শক্ত করে ক্ষতস্থানে বেঁধে দাও। আল্লাহ মেহেরবান, সে আমাদের সাথে বিজয় উদযাপনের জন্য উপস্থিত থাকতে পারবে। একটা খাঁটিয়া তৈরি করে তাকে তাঁবুতে পৌঁছে দাও।”
“না আব্বাজান, পটি বাঁধা হতে আর পরিষ্কার পোশাক পরা হলে আমি আপনার সাথে আমাদের বাহিনীর অবস্থা পর্যবেক্ষণে বের হতে চাই।”
আধ ঘণ্টা পরে, সন্ধ্যার আলো আঁধারির ভিতরে বাবর আর হুমায়ূন যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে বেড়ায়। মশালের আলোতে বাবরের খাঁটিয়া বাহকের দল নিজেদের লোকদের উপরে ঝুঁকে পড়ে আহতদের মৃত যোদ্ধাদের থেকে আলাদা করে। শিবির অনুসরণকারী আর মুদ্দাফরাসের দল ময়দানের চারপাশে আঁধারের আড়াল ব্যবহার করে মৃত রাজপুত যোদ্ধাদের লাশ থেকে মূল্যবান সামগ্রী খুলে নেবার জন্য হায়েনার মতো কামড়াকামড়ি করতে থাকে। বাবর আর হুমায়ূন তাদের দলবল নিয়ে হাজির হতে তারা আঁধারে মিলিয়ে যায়।
পিতা ও পুত্র নিরবে তাদের আহত যোদ্ধাদের যেখানে রাখা হয়েছে সেইসব তাঁবুর কাছে উপস্থিত হয়। কেউ কেউ অসাড় হয়ে শুয়ে আছে, কেউবা ক্ষতস্থান থেকে মাছি তাড়ায়, কেউ যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে, কেউ আর্তনাদ করা থেকে বিরত থাকতে হাত কামড়াচ্ছে এবং অন্যরা সাহায্য প্রার্থনা করছে।
“আব্বাজান এটা তাহলে সত্যি মারাত্মক আহত যারা, তারা হয় মায়ের জন্য নতুবা আল্লাহর জন্য কান্নাকাটি করে।”
“তাদের মায়েরাই তাদের জন্য নিঃশর্ত আর প্রশান্তিদায়ক স্থান এবং আল্লাহ তাদের পরবর্তী জীবনের জন্য বিরাট আশার স্থল।” বাবর চুপ করে থেকে কি ভাবে তারপরে আবার বলে, “আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, এই লোকগুলোর সাহসিকতা আর আত্মত্যাগের কারণেই আমরা আজ হিন্দুস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি হতে পেরেছি। আমরা তাদের এই বলিদানের বদলে তাদের পরিবার যেনো সুখে শান্তি তে থাকে তার ব্যবস্থা করবো এবং যারা বেঁচে আছে তাদের যথোপযুক্ত প্রতিদান দেবার ব্যবস্থা নেবো। সবচেয়ে বড় কথা আমরা এজন্য তাদের কাছে ঋণী এবং তাদের এই আত্মদান নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার আমাদের নেই। কিন্তু একই সাথে আত্মত্যাগ আর মৃত্যুর মাঝে আটকে থাকলে চলবে না। সবাই শাসক বা প্রজা নির্বিশেষে-সাম্রাজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে বেশি সচেতন হয়ে উঠবার অর্থ হল দুর্বল আর দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উঠা। আজ রাতে আমরা আমাদের বিজয় উদযাপন করবো। আমরা আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রুকে পরাজিত করেছি। তার সমূলে ধ্বংস হবার খবর যখন অন্য শাসকরা জানতে পারবে, তখন তারা আমাদের। আক্রমণের কথা চিন্তাও করবে না। আমাদের সাম্রাজ্যের জন্য আজ আমরা একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিশ্চিত করেছি।”
*
পরের দিন দুপুর নাগাদ ছায়া দীর্ঘ হতে শুরু করলে, বাবর আরও একবার তার চারপাশে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়। অনেকের শরীরে পট্টি বাঁধা, কেউ আবার লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
“ভাইয়েরা আল্লাহতালার কাছে হাজার শুকরিয়া। তিনি আমাদের ন্যায়সঙ্গত কারণের প্রতি তোমাদের বিশ্বাস আর তোমাদের সাহসের জন্য আমাদের মহান এক বিজয় দান করেছেন। আমরা আরো একবার তৈমূরের যোগ্য উত্তরসূরী হিসাবে নিজেদের যথার্থতা প্রমাণ করেছি এবং ইতিহাস আমাদের এভাবেই স্মরণ করবে গতরাতে আমরা বিজয়োল্লাস করেছি এবং আগ্রায় ফিরে যাবার পরে, যা কেবল চারদিনের দূরত্বে অবস্থিত, আমি আরো একবার আমার কোষাগার উলঙ্গ করে তোমাদের সবাইকে উপযুক্তভাবে পুরস্কৃত করবো।
আমি গতরাতে এক বন্দির কাছে জানতে পেরেছি যে, যুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায় রানা শঙ্ক- আমাদের উদ্ধত প্রতিপক্ষ যে, আমাদের সামনে দাঁড়াবার সাহস দেখিয়েছিলো- পেটে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হবার কারণে তাকে চারটা ঘোড়ার মাঝে একটা হাল্কা খাঁটিয়ায় করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। আজ গুপ্তদূতেরা, রাজপুতেরা আবার যুদ্ধের জন্য একত্রিত হচ্ছে কিনা দেখতে গিয়ে এখান থেকে দশ মাইল দূরে একটা রাজকীয় অন্তেষ্টিক্রিয়ার মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে দেখতে পায়। মাঠে কাজ করতে থাকা এক কৃষক তাদের জানায় যে, সেটা রানা। শঙ্কের জন্য নির্মিত হয়েছে। যিনি নিকটেই দেহত্যাগ করেছেন। আর তার দেহরক্ষীরা তার জন্য মঞ্চটা তৈরি করেছে। আমাদের গুপ্তদূতেরা ক্ষেতের ভিতরে লুকিয়ে থেকে দেখে যে, সত্যি সত্যি তার দেহ মঞ্চের উপরে স্থাপন করা হয়েছে। কাঠের স্তূপের নিচে আগুন জ্বালাবার পরেই কেবল তারা সে স্থান ত্যাগ করে। পেছনে তাকিয়ে তারা কমলা আগুনে আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখেছে। রানা তার একাশিতম ক্ষতচিহ্ন উদযাপনের জন্য বেঁচে নেই। আগুনের শিখা আমাদের এই নতুন ভূমি থেকে উচ্ছেদের রাজপুতানা আশা ভষ্ম করে দিয়েছে।
“বাকি যারা বেঁচে আছে। যারা এখন আমাদের বিরুদ্ধে মনে মনে আমাদের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করে। তারা আমাদের মোকাবেলা করার ফলে কি দুর্গতি হতে পারে এবার বুঝতে পারবে। আমরা আবারও তৈমূরের রীতি অনুসরণ। করবো। আমি শত্রুপক্ষের মৃত যোদ্ধাদের মাথা কর্তনের হুকুম দিয়েছি এবং এখান থেকে আগ্রা পর্যন্ত প্রতিটা চৌরাস্তায় একটা কর্তিত মুণ্ডের স্তূপ তৈরি করতে বলেছি। আশা করা যায় আমাদের শত্রুরা এর সাথে সাথে পচে মরবে।”