“আমাদের এক হিন্দু মিত্র আমাকে বলেছে এই ধরনের আক্রমণের আগে তারা আফিম খেয়ে নেয় ভয় আর আঘাতের যন্ত্রণা লাঘব করতে… “
“কোনো সন্দেহ নেই। ঐ তারা এগিয়ে আসছে…”
তূর্যধ্বনি, ঢোলের সম্মোহনী বোল আর খোল, করতালের বিকট শব্দে রাজপুত বাহিনী এগিয়ে আসতে থাকে। এবার তাদের অগ্রসর হবার বেগ অনেক শ্লথ সাথে পদাতিক সৈন্য রয়েছে বলে।
“সহিসকে আমার ঘোড়া প্রস্তুত রাখতে বলল।” চিৎকার করে হুমায়ূনকে বলে। “সময় হলে এবার আক্রমণের নেতৃত্ব আমিই দেবো।”
“আমিও আপনার পাশে থাকতে চাই।”
“কিন্তু তার আগে আমাদের বাদ্যযন্ত্রীদের বলো যে রাজপুত বাহিনীর চেয়ে বেশি আওয়াজ করতে এবং আমাদের সব সেনাপতিকে জানিয়ে দাও যে রাজপুতরা প্রতিবার রণ হুঙ্কার দেয়ার সাথে সাথে তারাও যেন উত্তরে, আল্লাহু আকবর’ বলে চেঁচিয়ে উঠে- এটা তাদের মনোবল বৃদ্ধি করবে।”
অগোছালো রাজপুত বাহিনী সামনে এগিয়ে আসে। বাবরের গোলন্দাজ বাহিনী কামানের গোলা বর্ষণ করে তাদের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে। মাস্কেট আর তীরন্দাজের দল ঘোড়ার পিঠ খালি করতে থাকে। মাঝে মাঝে একটা হাতি হয়তো কাত হয়ে উল্টে পড়ে যায় বা আহত এবং আতঙ্কে ঘুরে দাঁড়িয়ে চারপাশের সবাইকে বিপর্যস্ত করে তোলে। রাজপুত বাদকের দল এখনও তাদের সম্মোহনী বাজনা অব্যাহত রেখেছে। সারির মাঝে সৃষ্ট ফাঁকা স্থান পূর্ণ হওয়া বজায় থাকে। বাবরের মাথায় “মেওয়ার” আর “আল্লাহু আকবর ধ্বনি তালগোল পাকিয়ে যায়। কামানের শব্দ আর আহতদের আর্তনাদ যেনো তার নিচে চাপা পড়ে।
বেষ্টনী থেকে মাত্র দুশো গজ দূরে যখন রাজপুত বাহিনী। তাদের অশ্বারোহী বাহিনী পূর্ববর্তী আক্রমণে নিহতদের লাশের উপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে ধেয়ে আসে। পদাতিক বাহিনী তাদের মৃত সহযোদ্ধাদের লাশ কোমল পাদানির মতো ব্যবহার। করে পরিখা অতিক্রম করতে এবং বেষ্টনী টপকে যেতে। পুরো প্রতিরক্ষা ব্যুহ জুড়ে ব্যক্তিগত আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু বাবর আর হুমায়ূন যেখানে দাঁড়িয়ে, ঠিক তার পাদদেশে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সংঘর্ষ শুরু হয়।
“আমরা ঐখানে আমাদের বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বো।” কোষ থেকে আলমগীর টেনে বের করেবাবর তার অশ্বারোহী বাহিনীকে আরো একবার সামনে এগিয়ে যেতে আদেশ দেয়। তারপরে তাদের নেতৃত্ব দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অবশিষ্ট বেষ্টনী অতিক্রম করে সরাসরি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। এবার পাহাড়ের উপর থেকে তাদের ধেয়ে আসা আক্রমণের তোড়ের সামনে রাজপুত বাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। তাদের ঘোড়া পেছনে সরে গিয়ে পদাতিক বাহিনীকে পিষ্ট করে। সে এগিয়ে যেতে যেতে খেয়াল করে এক রাজপুত তীরন্দাজ তাকে লক্ষ্য করে ধনুক উঠিয়েছে এবং সে এগিয়ে গিয়ে তাকে নিষ্ক্রিয় করার আগেই ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত তীর তার ঘোড়ার জিনের চামড়ার হাতলে এসে গেঁথে যায়। বাবর রাজপুত তীরন্দাজের অরক্ষিত দেহ লক্ষ্য করে তরবারি চালায়। অল্প সংখ্যক রাজপুত যোদ্ধাই সামর্থ থাকা সত্ত্বেও ইস্পাতের তৈরি মিহি বর্ম পরিধান করে এবং সে বাবরের ঘোড়ার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে।
রাজপুত বাহিনীর ভিতর থেকে বের হয়ে এসে বাবর তার ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। যখন হুমায়ূন আর অন্য যোদ্ধারা, বাবর উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে হুমায়ূনের শিরস্ত্রাণ কোথায় যেনো পড়ে গেছে। তারা পাশে এসে একত্রিত হয়। তারপরে তারা আবার রাজপুত বাহিনীর দিকে ধেয়ে যায়, অবশ্য এবার পেছন থেকে। যদিও তারা বীরেরমতোই যুদ্ধ করে। কিন্তু কমলা রঙের পোশাক পরিহিত যোদ্ধার দল শীঘ্রই বেষ্টনীর ভিতরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে আটকে পড়ে এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে থাকে। পাঁচজনের একটা দলকে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া হলে তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে একে অন্যকে তরবারি বিদ্ধ করে। কিন্তু সর্বত্রই যুদ্ধের তীব্রতা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। বাবর এবার বুঝতে পারে বিজয় তার কুক্ষিগত হয়েছে।
তারপরে সে খেয়াল করে তার একশ গজ ডানে, হুমায়ূন মাটিতে পড়ে রয়েছে এবং তার তিনজন দেহরক্ষী তার দেহের নিম্নাংশের বস্ত্র কেটে সরিয়ে নিচ্ছে। সে সেদিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পিতৃসুলভ আশঙ্কা নিমেষে বিজয়ের আনন্দ ম্লান করে দেয়। সে হুমায়ূনকে সজাগ দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যদিও বেচারা ব্যাথায় কুঁচকে রয়েছে। “কিছু না উরু একটা তীর বিদ্ধ হয়েছে- পলাতক রাজপুতদের কারো ছোঁড়া একটা তীর কপালগুণে এসে লেগেছে।”
তীরটা এখনও তার ছেলের পায়ে থেকে বের হয়ে রয়েছে এবং রক্ত তীরটার ধাতব ফলা বেয়ে চুঁইয়ে বের হচ্ছে, যদিও কেবল অর্ধেকটা হুমায়ুনের দেহের ভিতরে প্রবেশ করেছে। দেখে মনে হচ্ছে খুব একটা গভীরে প্রবেশ করেনি। কিন্তু তারপরেও দ্রুত বের করতে হবে- বহু বছরের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে এটা আমি জেনেছি। আমি আমার ছেলের কাঁধ চেপে ধরছি।” বাবর হুমায়ূনের দেহরক্ষীদের বলে। “তোমাদের একজন তার গোড়ালি চেপে ধর। তোমাদের ভিতরে যে শক্তিশালী সে তীরটা বের করে আনবে। মনে রাখবে একদম সোজা টান দেবে কোনো ধরণের মোচড় দেবে না। হুমায়ূন শক্ত হও।”
বাবর তার ছেলের কাঁধ চেপে ধরে। সাথে সাথে আরেকজন তার পা চেপে ধরলে অন্যজন ঝুঁকে পড়ে দুহাতে তীরটার বাহু ধরে এবং একটানে বের করে আনে। রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হয় কিন্তু শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যায়।