বাবর পাহাড়ের ঢাল থেকে মাস্কেটধারীদের নল থেকে ধোঁয়া নিঃসরিত হতে দেখে এবং তার কাছে কামানের মুখ থেকে তীব্র কটুগন্ধযুক্ত সাদা ধোয়া নির্গত হয়। তার প্রতিরক্ষা ব্যুহের পশ্চিমবাহুর এক স্থানে বাবর দেখতে পায় রাজপুত অশ্বারোহীদের একটা দল ভেতরে ঢুকে পড়েছে তার বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে এবং বেষ্টনীর। সামনে দিশেহারা হয়ে পড়ে পিছিয়ে যায় পুনরায় সংগঠিত হতে। অবশ্য পূর্বদিকের বাহুতে সে দেখে রাজপুত অশ্বারোহীদের একটা দল মাটির বেষ্টনীর উপরে লাফিয়ে অবতরণ করে বা, ঘোড়া দাবড়ে ঢালে উঠে এসে সেখানে অবস্থিত মাস্কেটধারী আর তিরন্দাজদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বাবর বেশ কয়েকজনকে রাজপুতদের তরবারির ঘায়ে ভূমিশয্যা নিতে দেখে। যারা এরপরে কামানের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে।
বাবর সাথে সাথে, হুমায়ূনকে ইশারায় তার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যেতে বলে। হুমায়ূন, তার তাজিক দেহরক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় তাড়াহুড়ো করে বিশৃঙ্খল ভঙ্গিতে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে রাজপুতদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হুমায়ূনের আক্রমণের দাপটের সামনে টিকতে না পেরে অনেক রাজপুত অশ্বারোহী ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে যায়। অন্যরা তার সাথে হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং বেষ্টনীর পেছন থেকে প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সৈন্যরা সরে যেতে সেখান দিয়ে লাফিয়ে আরো রাজপুত সৈন্য এসে যোগ দেয়। হুমায়ূন বীরত্বের সাথে লড়াই করে। কিন্তু ধোয়ার আড়াল সরে যেতে বাবর তাকিয়ে দেখে রাজপুত সৈন্যরা তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলছে। তারপরে আবার ধোয়া এসে তাকে আর তার দেহরক্ষীদের পুরোপুরি ঢেকে ফেলে।
বাবরের কাছে মনে হয় এক যুগ পরে যেনো আবার ধোয়ার আড়াল সরে যায়। কিন্তু বস্তুতপক্ষে ধোয়া কিছুক্ষণ পরেই সরে গিয়েছিলো। যখন সে দেখে যে রাজপুতরা পাহাড় বেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে এবং বেষ্টনীর ওপাশে সরে পড়ছে। পাঁচ মিনিট পরে হুমায়ূন ঢাল বেয়ে তার কাছে উঠে আসে।
“এতো ধোয়া আমি ঠিকমতো বুঝতে পারিনি, কি ওখানে কি ঘটছে?”
“আমাদের প্রথম আক্রমণের ঝাপটা তাদের সামান্যই পিছু হটিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু তারা পুনরায় সংঘটিত হয় এবং আমাকে দলনেতা বুঝতে পেরে বাকিদের থেকে আলাদা করে দিতে চেষ্টা করে।”
“এই পর্যন্ত আমিও দেখেছি।”
“বেশ, আমার দেহরক্ষীরা তাদের প্রয়াস ব্যর্থ করে দেয়। আর আমি রাজপুতদের সুদে আসলে তাদের এই প্রয়াসের উত্তর দেই। আমরা জটলার ভেতর থেকে বের হয়ে এসে তাদের একজন সেনাপতিকে আক্রমণ করি- বিশাল কালো গোফঅলা এক যোদ্ধা যার পাগড়িতে ময়ূরের পালক গোঁজা ছিলো। আমি প্রথমে তার কাছে পৌঁছাই এবং তার গলা আর মুখ লক্ষ্য করে একবার তরবারি চালাতেই সে জিনের পিঠ থেকে উল্টে গিয়ে মাটিতে নিথর অবস্থায় পড়ে থাকে। বাকি যোদ্ধারা কার্যত এর ফলে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং মাস্কেটধারীরা পাশে নতুন অবস্থান গ্রহণ করায় তাদের সহায়তায় আমরা তাদের পিছু হটিয়ে দেই। শীঘ্রই আমাদের ব্যুহ আবার সুরক্ষিত হয় এবং সামনের বেষ্টনীতে আবারও সৈন্যবিন্যাস করা হয়।”
“তুমি দারুণ দেখিয়েছে।”
“আমাদের কি এগিয়ে গিয়ে তাদের আক্রমণ করা উচিত না?”
“এখনও সময় হয়নি। তাদের উদ্যম বা শক্তি কোনোটাই এখনও প্রশমিত হয়নি। দেখো? তারা পুনরায় আক্রমণের জন্য একত্রিত হচ্ছে। আমার লোকদের কাছে পানির থলি আর তীর পৌঁছে দিতে সরবরাহকারীদের নির্দেশ পাঠাও। যুদ্ধ কেবল শুরু হয়েছে।”
বাবরের আশঙ্কাই ঠিক প্রমাণিত হয়। সারা দিন প্রচণ্ড গরমের ভিতরে রাজপুত বাহিনী থেকে থেকেই আক্রমণ চালাতে থাকে। প্রতিবারই প্রতিরক্ষা ব্যুহে ফাটল ধরাবার আগেই তাদের প্রতিহত করা হয়। বেষ্টনীর কাছে মৃত, আহত মানুষ আর ঘোড়ার স্তূপ জমে উঠে। বাবর আহত এক রাজপুত যোদ্ধাকে আধা হামাগুড়ি আধা পায়ে হেঁটে রাজপুত শিবিরের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে। ধীরে ধীরে প্রচণ্ড কষ্ট সহ্য করে সে সাতশ গজ পেছনের দিকে এগিয়েছে যখন, রাজপুত অশ্বারোহী বাহিনীর একটা নতুন ঝটিকা আক্রমণ তাকে অগ্রাহ্য করে ধেয়ে আসে এবং বেচারার লাশ পাথুরে মাটিতে দুমড়েমুচড়ে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকে। তার মাথার পাগড়ি অর্ধেক খুলে গিয়ে যায় এবং মাঝে মাঝে বাতাসের আন্দোলনে একমাত্র সেটাকেই নড়াচড়া করতে দেখা যায়।
সূর্য যখন প্রায় অস্তমিত হয়ে আসছে এমন সময় হুমায়ুন তার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে আরেকটা আক্রমণের প্রস্তুতির দিকে আঙ্গুল তুলে দেখায়। “তারা সম্ভবত আরেকটা আক্রমণের পাঁয়তারা করছে। হাতি আর অশ্বারোহী বাহিনী আগের মতোই সজ্জিত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের মাঝে পদাতিক বাহিনীর একটা বিশাল অংশ সমবেত হয়েছে। এমন আজ সারাদিনে দেখা যায়নি। আর এবার আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে তারা সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে পরিচারক আর শিবিরে অস্ত্র ধরতে পারে এমন সবাই এসে জড়ো হয়েছে।”
“সম্ভবত তারা তাই। আমি শুনেছি মামুলি পানি বহনকারীও নাকি পরাজিত হয়ে ফিরে যাবার চেয়ে একটা শেষ আক্রমণ করে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পছন্দ করে। তারা এই আক্রমণকে বলে জহর। আক্রমণের আগে তারা পূজো করে এবং তাদের সংকল্প দৃঢ় করতে দেবতার সামনে বলি দেয়।”