যেমন আশা করা হয়েছিলো, রানা শঙ্কের রাজপুত সম্মান এই অপমান বরদাশত করতে ব্যর্থ হয় এবং এই মুহূর্তে রানা বাবাজি নিচের সমতলে তিন মাইল দূরে এসে শিবির স্থাপন করে অবস্থান করছে। তার শিবির এখনও যদিও ভোরের প্রথম কুয়াশার চাদরে মোড়া। কিন্তু ভোররাতে পাঠানো গুপ্তদূতের দল একটু আগে ফিরে এসে বাবরকে জানিয়েছে যে তারা শত্রু শিবিরে আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণের সুনিশ্চিত দৃশ্য আর আওয়াজ শুনতে পেয়েছে- রান্নার আগুন নেভানো হয়েছে, তরবারিতে শেষ মুহূর্তের শান দেয়া চলছে, ঘোড়াগুলোতে জিন চাপান হয়েছে এবং সারিবদ্ধ হবার সংকেত ধ্বনি হচ্ছে।
বাবরের নিজস্ব সেনাশিবির কয়েকদিন আগে ঠিক- খানুয়ায় তার বাহিনী হাজির হবার অব্যবহিত পরেই আগের মতোই তার লাল তাঁবুটা কেন্দ্রস্থলে রেখে বিন্যস্ত হয়েছে।
“আমার ধারণা পানিপথের মতো একই যুদ্ধকৌশল আমাদের অবলম্বন করা উচিত।” সে কথা শুরু করে, “কিন্তু আমাদের উচিত হবে পাহাড়ের উচ্চতা ব্যবহার করে আমাদের অবস্থান আরো সমুন্নত করা। আমরা কামানগুলো পাহাড়ের মাথায় স্থাপন করতে পারি এবং পাহাড়ের চারপাশে পরিখা আর মাটির বেষ্টনী নির্মাণ করে তাদের সুরক্ষার বন্দোবস্ত করতে পারি।”
বাবরের বহুদিনের পুরাতন সেনাপতি সাধারণত মিতভাষী, হাসান হিজারী, বদখশান থেকে আগত এক তাজিক। প্রায় বিশ বছর সে বাবরের অধীনে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছে- তখন কথা বলে উঠে। “সেটা উত্তম প্রস্তাব, সুলতান, কিন্তু শঙ্কের কাছে আনুমানিক দুইশ’র মতো হাতি রয়েছে। আর সে মূলত তার অশ্বারোহী বাহিনীর উপরে নির্ভরশীল। পানিপথের চেয়ে এখানে আমাদের সেনাবিন্যাস অনেক লম্বা হবে। হিমবাহের মতো ধেয়ে আসা হাতির চেয়ে ঘোড়া অনেক বেশি দ্রুতগামী, যদিও কম ভীতিকর। কামানের গোলাতে রাজপুতদের অশ্বারোহী বাহিনী হতাহতের শিকার হলেও এর ফলে তাদের দমানো যাবে না। আমাদের সেনাবিন্যাসের কোথাও কোথাও তারা ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে, সেজন্য আমাদের প্রস্তুত থাকা দরকার।”
“আপনি ঠিকই বলেছেন। পাহাড়ের মাঝামাঝি তীরন্দাজ আর মাস্কেটধারীদের একটা সারি বাড়তি প্রতিরক্ষা ব্যুহ হিসাবে আমরা মোতায়েন করতে পারি।”
“আমাদের ওখানে অশ্বারোহী বাহিনীও প্রস্তুত রাখতে হবে। প্রতিরক্ষা ব্যুহের কোথাও যদি ফাটল দেখা দেয়, তবে সেটা সামলাবার জন্য।” হুমায়ুন মন্তব্য করে। “আমাকে সেটা সামলাবার দায়িত্ব দেয়া হোক।” বাবর তাকে নিষেধ করতে পারে না।
গত কয়েকদিন বাবরের সৈন্যরা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পরিশ্রম করতে থাকে। পরিখা খনন করে, কামানগুলোকে ষাঁড় দিয়ে টেনে পাহাড়ের মাথায় তোলে। তারা মালবাহী গাড়িগুলোর পাশে কাঠের তক্তা দিয়ে চাকা আড়াল করে সেগুলোকে স্থানান্তরযোগ্য প্রতিবন্ধকতায় রূপান্তরিত করে।
হুমায়ুন কয়েক মিনিট আগে বাবরের সাথে পুরো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে এসে সামান্য কিছু পরিবর্তন ছাড়া কোনো খুঁত খুঁজে পায় না। বাবাকে আলিঙ্গন করে পাহাড়ের সামান্য নিচে অবস্থিত অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে যোগ দেবার জন্য নেমে যায়। পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে বাবর আসন্ন যুদ্ধে হুমায়ূনের কুশল কামনা করে। হুমায়ূনের প্রতিবাদ সত্ত্বেও সে যুদ্ধবাজ তরুণের নিরাপত্তা জন্য তার সাথে একটা শক্তিশালী দেহরক্ষী বাহিনী দিয়েছে- হাসান হিজারীর তাজিকদের ভেতর থেকে বাছাই করা চল্লিশ জন যোদ্ধা। সে এর বেশি আর কিছু করতে পারবে না। কিন্তু এরপরেও সে উদ্বিগ্ন থাকে- পানিপথের যুদ্ধের শেষে বাবুরীর মাটিতে ঘষটাতে থাকা হাতের স্মৃতি এখনও দগদগে হয়ে আছে…
কুয়াশার আবরণ কেটে যেতে শুরু করেছে এবং বাবর দেখতে পায় যে রাজপুতেরা পুরোপুরি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সারির পরে সারি অশ্বারোহী বাহিনী দেখা যায়। বাবরের গুপ্তচরেরা হিসাব করেছে যে রানার সৈন্যদের সাথে তাদের বাহিনীর অনুপাত কমপক্ষে চারজনে একজন।
সহসা এক লম্বা রাজপুত অশ্বারোহী ঘোড়া ছুটিয়ে বাবরের সৈন্যবাহিনীর দিকে এগিয়ে আসে। তার পরণে কমলা রঙের পোশাক, তার ঘোড়ার জিন আর লাগামও একই রঙের টাসেল দিয়ে সজ্জিত। তার সাদা ঘোড়াটার মাথা একটা চকচকে ইস্পাতের শিরোস্ত্রান দিয়ে সুরক্ষিত করা, যা সকালের রোদে রীতিমত চমকাচ্ছে। বাবরের প্রতিরক্ষা ব্যুহ থেকে মাত্র একশ গজ দূরে সে ঘোড়াটা বৃত্তাকারে ঘোরাতে থাকে আর চিৎকার করে অনেকটা যুদ্ধ শুরুর ঘোষণার ভঙ্গিতে। বাবর তার মাস্কেটধারীদের অশ্বারোহীর ভবলীলা সাঙ্গ করার আদেশ দিয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তারা নির্দেশ পালন করে। লোকটা গুলির আঘাতে ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। কিন্তু তার পা রেকাবে আটকে যায় এবং ঘোড়াটা তাকে সেই অবস্থায় ছেচড়াতে ছেচড়াতে রাজপুত অবস্থানের দিকে টেনে নিয়ে যায়। পাথুরে মাটিতে ক্রমাগত আছড়াতে থাকার কারণে কমলা পাগড়ি পরিহিত মাথা শীঘ্রই রক্তাক্ত মণ্ডে পরিণত হয়।
বাবর ঠিক যা আশা করেছিলো, প্রথাগত আক্রমণ শুরুর আহবানের প্রতি তার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ রাজপুতদের মাঝে বিশৃঙ্খল হঠকারী একটা আক্রমণ প্রবণতার সৃষ্টি করে। তাদের অশ্বারোহী বাহিনী শীঘ্রই রানা শঙ্কের মোতায়েন করা একশ রণহস্তির থেকে অনেকটাই এগিয়ে সামনে চলে আসে। বাবর তার তরবারি নামিয়ে গোলন্দাজ বাহিনী, মাস্কেটধারী আর তিরন্দাজদের সংকেত দেয় শত্রুপক্ষ পাল্লার ভিতরে প্রবেশ করা মাত্র গুলিবর্ষণ করতে। পাহাড়ের উপরে তার অবস্থান থেকে, রাজপুত বাহিনীকে একটা বিশাল ঢেউয়ের মতো মনে হয় তার অবস্থান গ্রাস করার জন্য ধেয়ে আসছে। এখানে সেখানে একটা ঘোড়া কি দুইটা সৈন্য মাটিতে আছড়ে পড়ে। কখনও কখনও কামানের গোলা আপাতদৃষ্টিতে গদাই লস্করী কিন্তু আসলে দ্রুতগতিতে ধাবমান হাতির গতি রুদ্ধ করে। কিন্তু কিছুতেই তাদের সামনে এগিয়ে আসবার গতি থামবার লক্ষণ দেখা যায় না, যতক্ষণ না তারা পরিখা আর বেষ্টনীর উপরে আছড়ে পড়ে। যার আড়াল থেকে বাবরের তীরন্দাজের দল যান্ত্রিক ভঙ্গিতে তীর নিক্ষেপ করে চলেছে।