বাবর আরেক চুমুক পান করে। “হ্যাঁ, মদটা ভালো এবং আমি তৃপ্তি করে এটা উপভোগ করতেও জানি। আর সে কারণেই আমি মদ ত্যাগ করলে সেটা মনোবলের উপর বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। আমি সেজন্য চাই তুমিও পানাহারের অভ্যেস পরিত্যাগ করো।”
হুমায়ুন ঢোক গিলে।
“তুমি অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও…আমি কয়েকদিনের ভিতরেই মোল্লাদের সাথে আলোচনা করে নিয়ে আমার সৈন্যদের সামনে এই ঘোষণা দিবো এবং আমাদের হিন্দু মিত্রদের অন্য কাজে নিয়োগ করবো।”
*
একটা চতুস্কোণাকৃতি শূন্যস্থানের চারপাশে বাবরের সেনাবাহিনী সুসজ্জিত অবস্থায় সন্নিবেশিত করা হয়, যার মাঝের শূন্যস্থানে একটা কাঠের মঞ্চ স্থাপিত করা হয়েছে। পুরোটা সোনালী কাপড়ে মোড়ানো এবং এখন তাদের সম্রাট সেখানে সবুজ আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার কোমরবন্ধে মুক্তাখচিত এবং গলায় আকাটা চুনি আর পান্নার গর্জেট শোভা পায়। তার মাথায় সোনার মুকুট আর কোমরে আলমগীর ঝুলছে। তার পাশে উপযুক্ত রাজকীয় পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে হুমায়ূন দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বয়োজ্যেষ্ঠ মোল্লার দল। সবার পরনে কালো আলখাল্লা আর ডান হাতে কোরান শরীফ।
বাবর কথা বলতে আরম্ভ করে: “ভাইয়েরা, আমাদের এলাকায় অনুপ্রবেশের দুঃসাহস দেখিয়েছে উদয়পুরের যে উঁইফোড় রানা। আগামীকাল আমরা তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো। সে আমাদের ধর্মের অনুসারী না। সে সত্যিকারের এক আল্লাহ্র উপাসনা করে বহু দেবতার পূজা করে থাকে। ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে সে মনে করেছে পৃথিবীর বুকে বহুবার সে জন্ম লাভ করবে। আর এজন্যই বোধহয় সে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আমরা তাকে আমাদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব এবং আমাদের সাহস প্রমাণ করে দেখাবো। আমরা আমাদের একমাত্র জীবন ত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র ভীত নই। তার কারণ কাফেরের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হলে আমাদের বেহেশত নিশ্চিত। আমি আমাদের মোল্লাদের সাথে, আমার চারপাশে যেসব জ্ঞানী আর পূণ্যবানদের তোমরা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছো, আলোচনা করে দেখেছি। তারা একমত হয়েছে যে, আমরা যেহেতু কাফেরদের সাথে লড়াই করছি, আমাদের আল্লাহর প্রেমে উজ্জীবিত সাহসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের নিমিত্তে, এই যুদ্ধকে আমরা পবিত্র ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদ ঘোষণা করতে পারি। আমরা আল্লাহর জন্য, আমাদের বিশ্বাসের জন্য যুদ্ধ করবো। তার নামের মহীমায় ইনশাল্লাহ আমরা বিজয়ী হবো। আল্লাহু আকবর! আল্লাহ মহান!”
সৈন্যবাহিনীর সামনের সারি থেকে উচ্চকণ্ঠে সম্মতির আওয়াজ ভেসে আসে এবং মাত্রা আর উদ্দীপনায় বৃদ্ধি পেয়ে ধীরে ধীরে পুরো বাহিনীর ভিতরে ছড়িয়ে পড়ে। সৈন্যরা শূন্যে তাদের তরবারি তুলে ধরে এবং উন্মত্তের মতো ঢালে আঘাত করতে থাকে।
কয়েক মিনিট পরে, বাবর হাতের তালু নিচের দিকে করে অনবরত আন্দোলিত করে সবাইকে আরো একবার চুপ করতে বলে। উপস্থিত সবাই চুপ করতে সে পুনরায় বলতে শুরু করে: “তোমরা সবাই জানো আমি এমন একজন মানুষ, যে এখনও আল্লাহর নির্দেশ পুরোপুরি পালন করতে সমর্থ হয়নি। আমরা সবাই যেমন আমিও দুর্বলতার কারণে রিপুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। তোমরা জানো আমি মদ্যপান পছন্দ করি। তোমরা গজনীর সুরার কথা শুনে থাকবে- বছরের সেরা আঙ্গুর থেকে প্রস্তুত- যা কয়েক সপ্তাহ আগে আমি খাইবার গিরিপথের ভিতর দিয়ে নিজের ভোগস্পৃহা চরিতার্থের জন্য আনিয়েছি। পবিত্র যুদ্ধের প্রতি আমার নিষ্ঠা প্রকাশের নিমিত্তে আমি আজ থেকে মদ্যপান ত্যাগ করার কথা ঘোষণা করছি এবং আমার ছেলে হুমায়ূনও একই শপথ নিচ্ছে। আমার এই শপথের প্রতীকী প্রকাশ হিসাবে বহু কষ্টে হিন্দুস্তানে আমার নিয়ে আসা গজনীর সুরা আমরা এখন মাটিতে ঢেলে দেবো।”
বাবর কথা শেষ করার মাঝেই, সে আর হুমায়ূন মাথার উপরে কুঠার তুলে ধরে মঞ্চের সামনে সুরা রাখার কাঠের পিপেতে আঘাত করলে পিপে ফুটো হয়ে ভেতরের চুনির মতো লাল মদ বের হয়ে ধূলোর সাথে মিশে মাদকতাময় কাদার সৃষ্টি করে। এবারের উল্লাসের তীব্রতা প্রথমবারের চেয়েও বেশি। বাবরের অমাত্য আর সেনাপতিরা, সাথে অনেক সাধারণ সৈন্যও পরস্পরের সাথে চিৎকারে প্রতিযোগিতায় নামে যে তারাও নিজেদের বদলাতে ইচ্ছুক এবং মদপান থেকে বিরত থাকবে…যে পবিত্র আর পরিশুদ্ধ হয়ে তারা নিশ্চয়ই বিজয়ী হবে…
*
বাবর একটা নিচু টিলার উপরে দাঁড়িয়ে খানুয়ার নিকটবর্তী রাজস্থানের মরুভূমির লাল বালিরাশির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ঠিক পেছনেই রয়েছে, মূলত মাটির ইটের তৈরি বাড়িঘরসমৃদ্ধ খানুয়া গ্রামটা। গ্রামের মধ্যেখানে মায়ের পূণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে রানা শঙ্ক নির্মিত বেলেপাথরের উপরে জটিল কারুকার্যখচিত হিন্দুরীতির মন্দিরটা অবস্থিত। বাবর ন্যাড়া মাথার সাদা আলখাল্লা পরিহিত পুরোহিতদের দাঁড়িয়ে থেকে, মন্দির গায়ে রানা বা তার মায়ের স্মরণে খোদাই করা সব নিদর্শন তার লোকেরা গুঁড়িয়ে দিয়েছে বা বিকৃত করেছে, দেখতে বাধ্য করেছে। তারপরে সে পুরোহিতদের গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছে। সে জানে যে তারা বেত্রাহত কুকুরের মতো সংবাদটা নিয়ে রানার কাছে ছুটে যাবে।