চতুর রানা বিচক্ষণতার সাথে দ্রুতগতির যুদ্ধ বেছে নিয়ে নিজের অধিক দ্রুতগামী বাহিনীর সহায়তায় বাবরের দূর্গ আর রসদ সরবরাহের পথে ঝটিকা আক্রমণ বজায় রেখেছে। অনেক দিন আগে বাবর যেমন আক্রমণ ফারগানার পাহাড়ী এলাকা থেকে তার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরের লোকদের বিরুদ্ধে পরিচালনা করেছিলো। আক্রমণের ফলে বাবরের বাহিনীর মনোবল দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদের অস্থির করে তুলেছে। এবং তারা এখন সবসময়ে আক্রমণের আশঙ্কায় তটস্থ থাকছে। ঝটিকা আক্রমণের ফলে বাবরকে ক্রমাগতভাবে তার শ্রেষ্ঠ বাহিনীর একটা বিশাল অংশকে মালামাল বহনকারী বহরের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত করতে হয়েছে।
হুমায়ুন এখন তার পাশে এসে পৌঁছায়। “দশ বছর আগে তোমার সেই সাদা টাট্ট ঘোড়াকে আমি যেমন পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতাম, এখনও তোমাকে সেভাবে আমি হারিয়ে দিতে পারি…”
“আপনার ঘোড়াটা সেরা। আর ফলাফল ভিন্ন হতো যদি আমরা নিজেদের পায়ের উপরে ভরসা করতাম।” নিজের বাবার সাথে বয়ঃসন্ধিক্ষণের প্রতিযোগিতা আর পরাজয় উপলব্ধি করে এই বয়সের স্পর্শকাতরতায় প্ররোচিত হয়ে খেপে গিয়ে, হুমায়ুন উত্তর দেয়।
“আমি ঠাট্টা করছিলাম। যাই হোক, আমরা দুজনেই আপাতদৃষ্টিতে রানাকে পাকড়াও করতে ব্যর্থ হয়েছি। সে যদিও আমাদের চেয়ে বয়সে বড় আর পঙ্গু। নিচের ঐ সমভূমি জনমানবশূন্য। আমাদের পুনরায় ভাবতে হবে। আজ রাতে আমরা একাকী আহার করবো, যাতে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারি।
*
সাদা জোব্বা আর ঢোলা পাজামা পরিহিত পরিচারক দু’জন খাবারের শেষ পদ নিয়ে আসবার জন্য তাঁবুর পর্দা উঠিয়ে বের হয়ে যায়- কমলা, বাদাম আর আঠাল মিষ্ঠান্ন। বাবর আর হুমায়ূন নিচু টেবিল থেকে পেছনে সরে এসে, একদা ইবরাহিমের দিল্লীর প্রাসাদের শোভাবর্ধন করতো এমন হাতি আর ময়ূরের নকশা করা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে। কাবুলের দক্ষিণে অবস্থিত গজনীর দ্রাক্ষাকুঞ্জ থেকে সদ্য আগত ওয়াইনে পূর্ণ দুটো সোনার পানপাত্র দুজনের হাতে।
“আমি ভাবছিলাম রানাকে কিভাবে আমরা যুদ্ধে প্রলুব্ধ করতে পারি।” হুমায়ূন তার পানপাত্র নামিয়ে রাখে। “আমরা দুজনেই জানি রাজপুতের কাছে সম্মানই- তার নিজের আর নিজের পরিবারের সম্মান- সবকিছু। আমরা রানার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্থান দখল করবো, যাতে সে ভাবতে বাধ্য হয় স্থানটা দ্রুত পূনর্দখল করতে না পারলে তার সম্মানহানি ঘটবে।”
“নীতিগতভাবে ভালো পরিকল্পনা। কিন্তু সেরকম কোনো স্থানের কথা কি তোমার জানা আছে?”
“আমি আমাদের স্থানীয় মিত্রদের ভিতরে বেশ কয়েকজন সর্দারের সাথে কথা বলেছি। তারা আমাকে বলেছে শঙ্কের মা আগ্রার উত্তর-পশ্চিমে তার এলাকা থেকে বিশ মাইল দূরে একটা ছোট গ্রাম খানুয়াতে জন্মেছিলেন- এখান থেকে জায়গাটা পঁচাত্তর মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। মায়ের সম্মানে সে সেখানে তাদের কূলদেবতার মন্দির নির্মাণ করেছে এবং এখনও বছরে একবার পূজো দিতে যায়।”
“তুমি নিশ্চিতভাবেই এ বিষয়ে ভালোমতো ভাবনাচিন্তা করেছে। আমি আগামীকাল সকালেই খানুয়া আর এখানের মধ্যবর্তী এলাকা রেকী করার জন্য গুপ্তদূত পাঠাবো এবং তাদের আরো দেখে আসতে বলবো এলাকা আমাদের লড়াইয়ের জন্য উপযুক্ত কিনা। সবকিছু ঠিক থাকলে আমি আমার সৈন্যদের কয়েক দিনের ভিতরে সেখানে জড়ো হবার আদেশ দেবো। কিন্তু তুমিই কেবল এ বিষয়ে চিন্তা করছে না। আমি চিন্তিত রানা শঙ্কের ঝটিকা আক্রমণের ফলে মনোবল দুর্বল হয়ে পড়া আমাদের যোদ্ধাদের কিভাবে চাঙ্গা করে তুলবো।”
“আপনি ভেবে কি ঠিক করেছেন?”
“আমার সিদ্ধান্তটা একটু উদ্ভটই শোনাবে হয়তো। অতীতে আমার সব অভিযানই ছিলো এমন শত্রুর বিরুদ্ধে, যাদের ভিতরে সামান্য সংখ্যক হলেও কিছু লোক ছিলো যারা আমার ধর্মমতে বিশ্বাসী। এইবার আমার প্রতিপক্ষের সবাই হিন্দু- মানে বলতে গেলে কাফের। আমরা একটা পবিত্র ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করবো- জিহাদ।”
“কিন্তু আমরা এখন হিন্দুস্তানে আর স্থানীয় শাসকদের ভিতরে আমাদের মিত্র যারা তাদের ভেতরে অনেকেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী।”
“এইবারের যুদ্ধে তাদের মূল বাহিনী থেকে আগেই পৃথক করে ফেলতে হবে। আমি অবশ্য এখনকার মতো তাদের অনেকের আনুগত্য বা নিদেন পক্ষে, তার কার্যকারিতার বিষয়ে বেশি চিন্তিত। তারা পেছনের দিকে সৈন্য মোতায়েন করতে পারবে।”
“এতে কাজ হতে পারে।”
“এতে কাজ হবেই…আমি ভেবে রেখেছি কিভাবে এই পরিবর্তন প্রতীকীভাবে প্রকাশ করবো। গজনীর এই লাল ওয়াইনই আমার স্পর্শ করা শেষ এ্যালকোহল। আমার লোকদের সামনে আমি বাকি মদ আগামীকাল মাটিতে ফেলে দিয়ে তাদের আমি জিহাদের ডাক দেবো।”
“কিন্তু আমি আপনাকে সারা জীবন পান করতে দেখে এসেছি…”
“হ্যাঁ, আর আমি জানি মদ, ভাঙ আর পপিগাছের ফল আফিমও আমি পছন্দই করি। আমরা, যাদের ধমনীতে তৈমূরের রক্ত প্রবাহিত এবং চেঙ্গিসের মোল্লারা আমাদের কাছে সত্যিকারের ধর্ম প্রচার করার বহু আগে থেকেই কড়া পানীয় পানে অভ্যস্ত। গাঁজানো ঘোড়ার দুধ খাভাশ উঁচু তৃণভূমিতে চেঙ্গিসের লোকদের শীতকালে ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচিয়ে রাখতো। কঠোর মোল্লারাও বুঝতে পেরেছিলেন যে মানুষকে পুরোপুরি আর সাথে সাথে বদলে ফেলাটা অসম্ভব। বিরত থাকাকে তারা আদর্শ বলে প্রচার করেন এবং ধার্মিক আর তপস্বীদের মদপান করা থেকে বিরত রাখতে সহায়তা করেন। কিন্তু একই সাথে ভোগবিলাসীদের পানাহারের প্রবণতা মেনেও নেন। তারা আমাদের সামান্য সময়ের জন্য বিরত থাকতে উৎসাহিত করেন- যেমন রমজানের পবিত্র মাসে এবং বৃদ্ধ হবার পরে যখন স্রষ্টার সাথে মিলিত হবার সময় ঘনিয়ে এসেছে।”