“তাহলে আপনি কাদের নিয়ে বেশি চিন্তিত?”
“আগ্রার পশ্চিমে বসবাসকারী রাজপুতদের নিয়ে। পাহাড়ে অবস্থিত দূর্গ আর শক্তিশালী ঘাঁটি থেকে তারা ইবরাহিমের সাথে একধরণের সশস্ত্র নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছিলো। এমনকি মাঝে মাঝে তার অন্যসব অভিযানে তারা তাকে অর্থের বিনিময়ে সৈন্যও সরবরাহ করেছে। তারা ভীষণ, ভীষণ সাহসী সৈন্য- যোদ্ধার জাত যারা কখনও পরাভব স্বীকার না করা। আর যুদ্ধক্ষেত্রে পিছু না হটার বীরোচিত সাম্মানিক স্মারকে বিশ্বাস করে।”
বাবর আবার চুপ করে। “রাজপুত রাজ্যগুলোর ভিতরে সবচেয়ে সমৃদ্ধ আর শক্তিশালী উদয়পুরের শাসক রানা শঙ্ক গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তার ঔদ্ধত্যের খবর নিয়মিত আমার কাছে আসছে যে, সে আমাদের মত উঁইফোড় হামলাকারীদের হাত থেকে হিন্দুস্তানকে মুক্ত করে, তিনশ বছরের ভিতরে প্রথমবারের মতো একজন সত্যিকারের হিন্দুকে- সেটা অবশ্যই সে নিজেকে বুঝিয়েছে- এর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করবে।”
“বাকী রাজপুত রাজ্যগুলো কি তাকে এ ব্যাপারে সমর্থন করবে?”
“সম্ভবত না। তারা স্বাধীনচেতা, একই সাথে ঈর্ষাপরায়ণ মানুষ। নিজেদের সম্মানের ব্যাপারে যেমন খুঁতখুঁতে, তেমনি পরস্পরের ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ। আর আফগান সর্দারদের মতো যেকোনো ছুতোয় যুদ্ধ শুরু করতে ওস্তাদ। অন্য রাজপুত শাসকরা তাকে আরও শক্তিশালী দেখতে পছন্দ করবে না।”
“সে নিজে তাহলে কতটা ঝামেলা করতে সক্ষম?”
“প্রচুর। তার অধীনে একটা বিশাল আর সুদক্ষ সেনাবাহিনী রয়েছে। যদিও তার বয়স হয়েছে। কিন্তু এখনও সে ভালো কৌশলজ্ঞ আর দক্ষ যোদ্ধা, যে সবসময়ে নিজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পছন্দ করে। সে যতোবার যুদ্ধে আহত হয়, আর দেহের কোনো অংশ হারায়, সেটাকে সে পূণ্যের বিষয় হিসাবে বিবেচিত করে। আমি শুনেছি তার সভাকবি তার হয়ে বীরগাথা লিখেছে যে সে মানুষের একটা খণ্ডিতাংশ মাত্র, কিন্তু খণ্ডিতাংশই বটে। ভাইয়ের সাথে যুদ্ধে তার এক চোখ নষ্ট হয়েছে। সুলতান ইবরাহিমের সাথে যুদ্ধে সে এক হাত হারিয়েছে। এবং পায়ে ভয়াবহ ক্ষত হবার কারণে এখন খুঁড়িয়ে হাঁটে। তার হাড্ডিসার দেহের অবশিষ্টাংশে আশিটা ক্ষতচিহ্ন রয়েছে এবং তার সভাকবি লিখেছে যে প্রতিটা ক্ষতচিহ্নের জন্য বুড়ো পাঠাটা একজন করে পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে।”
“আমিও সেটা শুনেছি। তার নিশ্চয়ই অসংখ্য স্ত্রী আছে- আর দৃশ্যত তার দেহের একটা অংশ এখনও অক্ষত রয়েছে। তাকে মোকাবেলা না করে কতোদিন আমরা তাকে এভাবে বড়াই করতে দেবো?”
“এই প্রশ্নটার উত্তরই আমি মনে মনে খোঁজার চেষ্টা করছি। মাত্র নয় মাস হয়েছে। আমরা ইবরাহিমকে পরাজিত করেছি। আমাদের বিজয় এখনও সুরক্ষিত হয়নি এবং হিন্দুস্তানে আমাদের সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ এখনও একটা দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। আমি চাই তুমি, তোমার অন্য ভাইয়েরা আর তোমাদের সন্তানেরা যেনো এই উদ্যানের শোভা উপভোগ করতে পারো। আজ সকালেই আমি জানতে পেরেছি বিদ্রোহী তাড়া করবার ছলে রানা শঙ্ক আমাদের সীমান্তের অভ্যন্তরে আরেকদফা অনুপ্রবেশ করেছে। যদিও এক সপ্তাহের ভিতরেই সে নিজ রাজ্যে ফিরে গিয়েছে। কিন্তু এইবার সে আগেরবারের চেয়ে অনেক অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলো…”
“তার ইচ্ছামতো আমরা তাকে আমাদের এলাকায় বিচরণ করতে দিতে পারি না। আমরা যদি তাকে নিজের রাজ্যের মতো তাকে বিচরণ করতে দেই, তবে সেটা আমাদের দুর্বলতা হিসাবে বিবেচিত হবে। আর সেটাই স্বাভাবিক। তাকে একটা শিক্ষা দেবার সময় হয়েছে।”
“যুদ্ধের প্রতি তোমার মতো উষ্ণ আবেগ আমি হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তোমার কথাই ঠিক। এক সময়ে না একসময়ে তাকে আমাদের মোকাবেলা করতেই হবে। নিজেদের যোদ্ধা খ্যাতি রক্ষার্থে সেটা যত তাড়াতাড়ি হয়, ততোই ভালো। আর তার চেয়েও বড় কথা হিন্দুস্তানে মাস্কেট আর কামান ব্যবহারে যতোদিন কেবল আমাদেরই একচেটিয়া অধিকার রয়েছে। অদ্ভুত আরেকটা অভিযান আমাদের নিজেদের তরুণ যোদ্ধাদের অস্থিরতা অনেকটা প্রশমিত করবে। যুদ্ধ আর লুটপাটের সম্ভাবনা তাদের অন্য কিছু ভাবা থেকে বিরত রাখবে। আমাদের প্রস্তুতি আরম্ভ করার জন্য আমি আগামীকাল সকালেই এক যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি সভার আহবান করবো…”
*
বাবর তার ঘোড়ার পর্যানে নড়েচড়ে বসে। হুমায়ুন যদিও ঠিক তার পেছনেই রয়েছে, কিন্তু তার নিজের দেহরক্ষীর দল বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে। সে গরমে দরদর করে ঘামছে। আর তার চোখের চারপাশের উন্মুক্ত অংশের চারপাশে প্রতিটা রোমকূপ ধূলোয় ঢাকা পড়েছে। চুয়াল্লিশ বছর বয়সে মাত্র আড়াই দিনে দেড়শ মাইল পথ ঘোড়ায় পাড়ি দিতে পেরে এবং পাহাড়ের উপরে এই সুবিধাজনক স্থানে তাদের আগে ঘোড়া ছুটিয়ে হাজির হতে পেরে সে নিজেই নিজের কৃতিত্বে উৎফুল্ল হয়ে উঠে।
এই পাথুরে শিলাস্তর থেকে নিচে রাজস্থানের শুকনো মরুভূমির একটা বেশ ভালো দৃশ্য চোখে পড়ে। সেখানে প্রীত হবার মতো উপাদানের সংখ্যা বড়ই অল্প। সে দেড়শ মাইল ঘোড়া দাবড়ে এসেছে রানা শঙ্ককে ধাওয়া করে। কিন্তু তাকে বা তার লোকদের এমনকি দিগন্তে ধূলোর কোনো চিহ্নও এখনও পর্যন্ত সে দেখতে পায়নি। গত ছয় সপ্তাহ ধরে সে ধাওয়া করে চলেছে। পুরোটা সময়ে সে তার শত্রুপক্ষকে মুখোমুখি যুদ্ধে আবদ্ধ করতে পারেনি, যেখানে তার মাস্কেট বা কামান- বিশেষ করে তার নতুন তৈরি করা কামান, যার সাহায্যে পৌনে এক মাইল দূরত্বে গোলা নিক্ষেপ করা সম্ভব- দক্ষতার সাথে কাজে আসবে।