হাতিটা একটা বিশাল মর্দা- প্রাণদণ্ড কার্যকর করার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। ইবরাহিমের আমলে এমন শাস্তির বিধান একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিলো। মাহুতের একটা সংকেতে, সে এখনও কানের পেছনেই বসে রয়েছে। হাতিটা তার বিশাল ডান পা তুলে সেটা বৃদ্ধার শরীরে উপরে রাখে। সে কোনো শব্দও করে না। তারপরে আরেকটা সংকেতের সাথে হাতিটা সুবোধ ভঙ্গিতে রোসান্নার উপরে পুরো পায়ের ভর চাপিয়ে দেয়। হুমায়ূন কোনো আর্তনাদ শুনতে পায় না। কেবল পায়ের চাপে একটা ভোতা শব্দ- সাথে রোসান্নার পেট ফেটে গিয়ে নাড়িভুড়ি বের হয়ে আসতে এবং পাজরের হাড় আর মেরুদণ্ড ভাঙার একটা মড়মড় শব্দ শোনা যায়। তারপরে সে প্রাণহীন আর অসাড় ভঙ্গিতে পড়ে থাকলে তার পরনের সাদা কাপড় রক্ত আর বিষ্ঠায় মেখে গেলে মাহুতের আদেশে হাতিটা ঘুরে দাঁড়িয়ে হতবাক লোকদের মাঝ দিয়ে আবার হাতিশালায় ফিরে চলে। সে বেশ ধীরেসুস্থে দেহের উপর থেকে রক্তাক্ত পা তুলে নেয়।
হাতিশালার দিকে পাঁচ পা ফিরে যাবার আগেই হুমায়ূন তার পেছনে দূর্গপ্রাকারে একটা গোলমালের আওয়াজ শুনতে পায়। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তার উপর দিয়ে এক বৃদ্ধাকে চিৎকার করতে করতে দৌড়াতে দেখে, পরনের কালো কাপড় বাতাসে উড়ছে: “আমার প্রিয় ইবরাহিম, প্রিয় রোসান্নারা তোমরা শান্তিতে বেহেশতে বিশ্রাম নাও। বাবর আর তার সন্তানদের অভিশাপ দিয়ে আমিও তোমাদের সাথে মিলিত হতে আসছি। হিন্দুস্তান তার বশ কখনও হবে না। তার ছেলেরা একে অন্যের সাথে লড়াই করে ধ্বংস হবে। তারা সবাই ধূলোয় বিলীন হয়ে যাবে।”
বুয়া, হুমায়ূন বুঝতে পারে। সে তাকিয়ে দেখে, ধাওয়াকারী প্রহরীদের ফাঁকি দিয়ে সে ছাদের কিনারায় পৌঁছে এবং নিচের প্রমত্তা যমুনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং পানির স্রোতে কালো চুলের জটলায় পেঁচিয়ে গিয়ে ভেসে যায়। পানিতে পুরোপুরি ডুবে যাবার আগে ঠিক তার মাথার উপরে বজ্রপাতের শব্দ শোনা যায়। বহু প্রতিক্ষিত ঝড় অবশেষে শুরু হয়েছে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। কুচকাওয়াজ ময়দানের জমাট কাদার উপরে আছড়ে পড়তে থাকলে হুমায়ূন দ্রুত দূর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
সেই রাতে বুয়ার দূর্গের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার দৃশ্য হুমায়ূনের স্বপ্নে বাবরের কাছে শোনা তার দাদাজানের আকশির দূর্গের দেয়ালের উপর থেকে কবুতরের চবুতরা নিয়ে নিচের গিরিকরে আছড়ে পড়ার দৃশ্যের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
*
“আমি এখন অনেকটা সুস্থ,” তিনদিন পরে বাবর হুমায়ূনকে বলে। “দুধের সাথে মিশিয়ে যে আফিম আমাকে আবদুল মালিক খেতে দিয়েছিলো পেটের ব্যাথা সেটা অনেকটাই প্রশমিত করেছে। এই প্রথমবারেরমতো আমার মনে হয়েছিলো যেনো মরতে বসেছি…অনেকবার এমন হয়েছিলো যে, আমি অনায়াসে মারা যেতে পারি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে সে সব পরে কখনও আমার ভাবনায় আলোড়ন তুলেনি। এইবার আমি কৃতজ্ঞ যে এখন প্রাণে বেঁচে আছি। ছোটখাট ব্যাপারও আমাকে আনন্দিত করছে- গবাক্ষ দিয়ে দেখতে পাওয়া ফুলের সৌন্দর্য, পাখির কলতান, সবকিছু। আমি আমার রোজনামচায় আমার ভাবনার কথা লিখে রাখছিলাম- শোনো…
“আল্লাহতালা যতদিন আমার হায়াত রেখেছেন প্রতিটা দিনের জন্য আমি তার কাছে শুকরিয়া জানাই। জীবন এত মধুর আমি আগে এটা বুঝতে পারিনি। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েই কেবল একজন জীবনের স্বাদ অনুভব করতে পারে। আমাকে আর আমার সন্তানদের দীর্ঘ জীবন দান করার জন্য আমি আল্লাহতালার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।”
৪.৬ জিহাদ
২৫. জিহাদ
কেন্দ্রে অবস্থিত একটা পানির হাউজে পানির নালাগুলো এসে মিলিত হবে, যেখানে ঝর্ণা আর পদ্মফুল থাকবে। আমি বাগানে আপেল, নাশপাতি গাছ লাগাই, যা আমাকে মাতৃভূমির কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। মালীরা আমাকে বলে যে, এসব গাছ বাঁচাতে হলে প্রতিদিন পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আর এখানে মজুর প্রচুর পাওয়া যায় আর সহজলভ্যও বটে।
বাবর আর হুমায়ূন যমুনার উত্তর তীরে দাঁড়িয়ে যেখানে আগ্রা দূর্গ থেকে মাইলখানেক ভাটিতে নদীটার খয়েরী পানি সহসা ডানদিকে একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে। বাবর হুমায়ূনকে আগ্রায় তার আরম্ভ করা প্রথম বাগিচার অগ্রগতি দেখায়। “আর কি কি আপনি তৈরি করার পরিকল্পনা করেছেন?”
“সুগন্ধ ছড়াবে এমন অসংখ্য সুগন্ধি গাছপালা লাগাবো আমি- যাতে সন্ধ্যাবেলা উদ্যানে সময় কাটাবার আমার প্রিয় সময়ে জায়গাটা সুরভিতে ভরে থাকে। প্রধান মালী আমাকে বলেছে অনেক গাছ আছে যার ভিতরে রাতের বেলা ফোটো সাদা রঙের চম্পা আমার উদ্দেশ্যের পক্ষে বিশেষ উপযোগী। লোকটা কাজ বোঝে। আর আমি কি চাই সেটা চটপট ধরতে পারে। যদিও সে এক সময়ে সুলতান ইবরাহিমের প্রধান মালীর কাজ করেছে।” বাবর দম নিতে থামে। “আমার একটাই আশা আমাদের সীমান্তের ভিতরে আর বাইরে বসবাসকারী লোকেরা দ্রুত আমাদের হিন্দুস্তানের নতুন প্রভু হিসাবে স্বীকার করে নিক। সুলতান ইবরাহিমের সাথে যাদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলো তাদের বৈরীতার কারণ –যদিও আমি সেটা বরদাশত করতে মোটেই প্রস্তুত নই আমি বুঝি। তার মা যা করেছে সেজন্য আমি তাকে দোষ দেই না- আমার ধারণা সেটা তিনি এক ধরণের আনুগত্য থেকেই করেছিলেন। আমি এই মুহূর্তে পারস্যের শাহ’কে নিয়েও খুব একটা চিন্তিত নই। যদিও আফগানিস্তানে আমাদের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে তিনি সবসময়েই একটা ঘোঁট পাকাতে চেষ্টা করছেন, কোয়েটা আর কান্দাহারে নিজের সমর্থকের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে। আমাদের কাছে কৃপণ ইবরাহিমের উপচে পড়া রাজকোষে সঞ্চিত অর্থের জন্য এখন শাহের চেয়ে বেশি উৎকোচ দেবার ক্ষমতা রয়েছে অন্তত এখনকার মতো।”