“আমিও তাই ভেবেছিলাম।”
“কিন্তু আপনাকে কিভাবে বিষ প্রয়োগ করা সম্ভব? আপনার নিজস্ব খাদ্য পরীক্ষাকারী রয়েছে আর রাঁধুনিদের উপরে সবসময়ে নজর রাখা হয়…”
“টাকা খুব দ্রুত আনুগত্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে এর পেছনে কারা রয়েছে। আর তাদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে- এতো কঠোর আর নির্মম শাস্তি দিতে হবে যাতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর না ঘটে। প্রথমে রাঁধুনি তারপরে খাদ্যপরীক্ষাকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করো। কেউ বিন্দুমাত্র আমতা আমতা করলে তাকে নিপীড়ন করো। প্রথমে আহমেদকে জিজ্ঞেস করো, সে কাকে সন্দেহ করে। তাদের দিয়ে প্রথমে শুরু করো। আর তোমার প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত থামবে না। আমি অনেক কষ্ট সহ্য করেছি। এবার তাদের পালা।”
দু’ঘণ্টা পরে হুমায়ূন গম্ভীর মুখে ফিরে আসে। “আপনার কথাই ঠিক… আপনাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিলো… অপরাধীরা দোষ স্বীকার করেছে এবং তাদের মূলহোতার নাম বলেছে।”
“বলো আমাকে।”
“আহমেদ বলেছিলো আমাদের প্রথমে হিন্দুস্তানী রাঁধুনিদের একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত- ছোটখাট দেখতে এক লোক। ইবরাহিমের অধীনে দশ বছর ধরে রাঁধুনির কাজ করছে এবং আগামী কয়েকদিনের ভিতরে তার নিজের আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিলো। লোহার গনগনে লাল শিক দেখে তাকে আর কিছু বলতে হয়নি। সে গড়গড় করে যা জানে সব বলে দিয়েছে। রোসান্নারা, ইবরাহিমের মা বুয়ার এক বৃদ্ধ পরিচারিকা। তার সাথে দেখা করেছিলো। সে তাকে বলে যে বুয়া বর্বরদের’, তিনি আমাদের এই নামেই সম্বোধন করে থাকেন। একটা শিক্ষা দিতে চান। তার ছেলের মৃত্যুর জন্য- রাঁধুনির পুরাতন প্রভু। আপনাকে বিষপ্রয়োগ করাটা একটা গর্বের আর অর্থকরী কাজ বলে বিবেচিত হবে এবং সে তাকে দুটো স্বর্ণ মুদ্রা দেয়। সে মোহর দুটো নেয় এবং বৃদ্ধা তখন তাকে একটা কাগজের পুটলিতে মোড়ানো বিষ দেয়।
“এই লোকটা ভীষণ চতুর। সে সময় ক্ষেপণ করে এবং আপনার একজন খাদ্যপরীক্ষাকারীকে হাত করে-আমাদের লোক যে নিজের দেশে ফিরে যাবার জন্য এত ব্যাকুল হয়ে ছিলো যে, সে তাকে সহজের ঘুষ দিয়ে হাত করে। যাতে সে আপনার খরগোসের মাংস পরীক্ষা না করে…ব্লাঁধুনী ধূর্ততার সাথে হিন্দুস্তানী পদে বিষ মেশায়নি, যাতে সন্দেহ এড়াতে পারে। তারপরে একেবারে শেষ সময়ে খরগোসের মাংসে বিষ মেশাবার সময়ে সে বাধাগ্রস্থ হয়েছিলো। সে কেবল উপরিভাগে বিষ ছড়াতে পারে এবং আগুনে ফেলে দেয়।
“আমরা খাদ্য পরীক্ষাকারী আর বৃদ্ধাকে প্রশ্ন করেছি। পরীক্ষাকারী অচিরেই করুণা ভিক্ষা চাইতে থাকে। কিন্তু বৃদ্ধা অনেক কঠিন চিড়িয়া। কিন্তু গরম লোহার শিক তাকে অচিরেই বশ মানায় যে, সে নিজের ভূমিকা স্বীকার করে। কিন্তু তাকে কে আদেশ দিয়েছিলো তার নাম জানবার জন্য তাকে আমাদের শেষপর্যন্ত পানিতে চোবাতে হয়েছে।”
“তুমি দারুণ কাজ করেছে।”
“আমরা এই বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে কি করবো?”
“তাদের জনসম্মুখে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।”
“বুয়াকেও?”
“না, সে শাহী পরিবারের সদস্য। তাকে আপাতত একটা পর্যবেক্ষণ বুরুজে আটকে রাখো। যেখান থেকে সে প্রাণদণ্ড কার্যকর করা চাক্ষুষ করতে পারে।”
“অন্যদের মৃত্যুদণ্ড কিভাবে কার্যকর করা হবে?”
“রাধুনীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্ন করো। খাদ্যপরীক্ষাকারী, বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে তার অপরাধ সবচেয়ে বেশি। আর সর্বোপরি সে আমাদের নিজেদের লোক। চাবকে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে। এবং বৃদ্ধাকে হাতির পায়ের নিচে পিষে হিন্দুস্তানী রীতিতে প্রাণদণ্ড কার্যকর করবে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ দুপুরবেলা কার্যকর করবে- আর দেখো হেঁশেলের রাঁধুনিরাসহ বেশ ভালো লোক যেনো জমায়েত হয় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা দেখতে। তোমাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আমি এখনও ভীষণ দুর্বল।”
*
বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে কিন্তু আকাশে তখনও মেঘ রয়েছে। হুমায়ূন যখন কুচকাওয়াজ ময়দানের কাদার ভিতরে লাল শামিয়ানার নিচে তড়িঘড়ি করে তৈরি করা মঞ্চে আসন গ্রহণ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা পর্যবেক্ষণ করতে। রাধুনীর মৃত্যুদণ্ড দ্রুত কার্যকর করা হয় এবং তার কর্তিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে যাওয়া হয় দূর্গের তোরণে প্রদর্শন করার জন্য। চাবুকের আঘাতে খাদ্যপরীক্ষাকারীর- মাটিতে হাতপা টানটান করে বাধা অবস্থায় শায়িত উচ্চকণ্ঠের আর্তনাদ প্রায় পাশবিক শোনায়। অনেকক্ষণ ধরে সে চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু একটা সময়ে সে নিরব হয়ে পড়লে তার মৃতদেহ পায়ের গোড়ালী ধরে কাদার উপর দিয়ে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় দূর্গপ্রাকারে সেটা প্রদর্শিত করা হবে বলে। এবার রোশন্নারার পালা।
দূর্গের বুরুজের নিচে অবস্থিত একটা ছোট প্রবেশপথ দিয়ে চারজন প্রহরী তাকে বের করে নিয়ে আসে। তার পরনে একটা সাদা সুতির আলখাল্লা। তার সাদা চুল আর শান্ত অভিব্যক্তির জন্য তাকে দয়ালু দাদীমার মতো সম্ভবত সে আসলেও তাই- দেখায়। সমবেত জনগণের গঞ্ছনা উপেক্ষা করে সে মাথা উঁচু রেখে ধীর পায়ে হুমায়ূনের দশ গজ সামনে স্থাপিত সামান্য উঁচু পাথরের মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়। প্রহরীদের কেউ তাকে স্পর্শ করার আগেই পাথরের উপরে পিঠ দিয়ে শুয়ে পড়ে। প্রহরীর দল এবার পাথরে স্থাপিত চারটা লোহার আংটার সাথে তার চার হাতপা বাঁধে, আংটাগুলোর কাজই এটা। বিষাণের ধ্বনির সাথে সাথে লাল রঙে রঞ্জিত কুচকাওয়াজ মাঠের বিপরীত দিকে অবস্থিত হাতিশালা থেকে হেলেদুলে বের হয়ে আসে ভীড়ের মাঝে। প্রহরীরা তার জন্য রাস্তা পরিস্কার করে দেয়।