“সুলতান এগুলো ইবরাহিমের রাঁধুনিদের রান্না করা গুড়ো ধনে আর বাটা সর্ষে, আদা, দারুচিনি আর এলাচের ঘন মিশ্রণে মাখা মাখা করে রান্না করা মুরগীর মাংস। হলুদ, পেঁয়াজ আর ডাল দিয়ে রান্না করা খাসির মাংস। তারপরে শাক দিয়ে রান্না করা মুরগীর আরেকটা পদ- আদা আর জায়ফল দিয়ে একটা পাত্রে আবদ্ধ করে আগুনের মাঝে সেটা পুঁতে রাখার কারণে কেমন ধোয়াটে একটা গন্ধ তৈরি হয়েছে। তারপরে রয়েছে বেগুন আর ওকরার ঝোল- প্রতিটা পদের স্বাদ অপূর্ব।
“সবগুলো পদই সুস্বাদু এবং মুখরোচক। কিন্তু আমার খরগোসের মাংস কোথায়?”
“আপনার পরিবেশনকারী সেটা নিয়ে আসছে।” পরিচারকের কথা শেষ হবার আগেই- লম্বা, মাথা ভর্তি ধুসর চুলের-এক পরিবেশনকারী একটা পাত্র বাবরের সামনে নিয়ে এসে সেটার উপর থেকে কাপড় সরিয়ে নেয়।
“আহমেদ, বরাবরের মতোই হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।”
“ধন্যবাদ, সুলতান।”
“আমার ছেলে হিন্দুস্তানী পদগুলো চেখে দেখুক, যাতে সে পরবর্তীতে আমাকে বলতে পারে কোনটা খেতে ভালো হয়েছে। কিন্তু আগে আমাকে আমার খরগোসের মাংস দাও।”
দু’জনে নিরবে খেতে শুরু করে। “আমাকে এবার বলো গুজরাটের সুলতানের কাছে দূত পাঠাবার জন্য কি বন্দোবস্ত করলে।” মুখ ভর্তি খরগোসের মাংস নিয়ে বাবর জানতে চায়।
“আমি বৃষ্টি থামবার সাথে সাথে যাতে তারা রওয়ানা দিতে পারে সেজন্য তাদের প্রস্তুত থাকতে বলেছি। আমাকে জানান হয়েছে অক্টোবরের আগে যাত্রা করা অসম্ভব। তখন হলে কি কোনো অসুবিধা হবে?”
“আমি দুঃখিত- তোমার শেষ কথাগুলো শুনতে পাইনি। আমার পেটের ভেতরটা আচমকা মোচড় দিয়ে ওঠাতে আমার মন গুজরাট থেকে একেবারে সরে গিয়েছিল।”
“আব্বাজান- আমি কি সুস্থ বোধ করছেন?”
বাবর মোটেই সুস্থ বোধ করছে না। তার সারা মুখ শীতল আর চটচটে ঘামে তার মুখটা ভিজে উঠেছে এবং তার পেটের ভেতরে গনগনে উত্তপ্ত একটা হাত যেনো আবার নাড়ীভুড়ি সব ধরে মুচড়ে দেয়। সে ব্যাথায় কুঁকড়ে যায় এবং হুমায়ুন আর এক পরিচারককে ইশারা করে তাকে তুলে দাঁড় করাতে বলে। তারা তাকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করার সময়ে আরেকটা মোচড় তাকে কাঁপিয়ে দেয় এবং সে মুখে বমির টকটক স্বাদ অনুভব করে। সে বমিটা গিলে ফেলতে চেষ্টা করে তারপরে আবার তার অন্ননালী গুলিয়ে উঠতে সে আবার ঢোক গিলে। খাবার টেবিল থেকে তিনপাও এগিয়ে যেতে পারেনি সে পাকস্থলী মুচড়ে বমি করে। সদ্য খাওয়া খরগোসের মাংস, সাথে লাল ওয়াইন আর আগে খাওয়া মিষ্টান্ন গোলাপী আর বেগুনী রঙের গলিচায় ছিটকে পড়ে।
বাবর আরেকটা মোচড়ের সাথে সাথে আবারও ভেতরের সবকিছু উগড়ে দেয়। বমির সাথে এবার রক্ত আর শ্লেষ্ম এবং পাঁচকরস উঠে আসে। যন্ত্রণায় সে পেট চেপে ধরে। “আমাকে মার্জনা করবে। আমি বুঝতে পারছি না কি হলো। আমি কখনও এভাবে অসুস্থ হইনি- অত্যাধিক মদ্যপানও আমাকে অসুস্থ করতে পারেনি। আমাকে ঐ বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দাও।”
হুমায়ুন আর পরিচারক বাবরকে ধরে নিয়ে গিয়ে মাথার নিচে তাকিয়া দিয়ে শুইয়ে দেয় এবং হুমায়ূন হেকিম ডেকে পাঠায়। “আব্বাজান, পানিটা পান করেন।” বাবর সুবোধ বালকের মতো হুমায়ূনের হাতে ধরা পাত্র থেকে চুমুক দেয় কিন্তু পানি তার পাকস্থলীতে পৌঁছানো মাত্র আবার খিচুনী শুরু হয় এবং পিচকারীর মতো বাবর বমি করে।
“আমাকে শৌচাগারে নিয়ে চলো- আমার পেট যে কোনো মুহূর্তে জানান দেবে।” বাবর উঠে বসতে চেষ্টা করে। হুমায়ুন তার বাবাকে আধা পাঁজাকোলে করে, আধা ধরে শৌচাগারে নিয়ে যায়। যেখানে সে তার পেটের ভেতরের সব কিছু প্রচণ্ড শব্দে, দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী তরল হিসাবে নির্গত করে। পাঁচটা কষ্টকর মিনিটের পরে বাবর শৌচাগার থেকে বের হয়ে আসে। আগের চেয়ে সামান্য সুস্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে। এখন কিন্তু মুখ এখনও ফ্যাকাশে হয়ে আছে, আর ঘামে ভেজা। “হুমায়ূন- ওদের বলো বমি যেনো পরিষ্কার না করে আমার ধারণা আমাকে বিষ দেয়া হয়েছে গালিচা থেকে বমি তুলে সেটা একটা কুকুরকে খেতে দাও। খরগোসের মাংস আরেকটা কুকুরকে খেতে দাও। রাধুনীদের, স্বাদপরখকারী আর অন্য পরিচারকদের পাহারায় রাখো। আমাকে এবার শুতে হবে। ভীষণ ক্লান্তবোধ করছি।”
*
পরের দিন সকালবেলা, হুমায়ূন তার বাবার শয্যাপাশে বসে আছে। বাবরের চেহারা তখনও ফ্যাকাশে এবং চোখের নিচে একদিনেই কালো দাগ পড়েছে। কিন্তু তাকে গতদিনের চেয়ে কিছুটা ভাল দেখায়।
“তিনি বমি না করে আজ কিছু তরল পান করতে পেরেছেন।” খয়েরী আলখাল্লা পরিহিত আবদুল মালিক কাবুল থেকে বাবরের সাথে আগত শক্তপোক্ত চেহারার, ধূসর চোখের হেকিম বলেন বাবরের পুরো পরিবারের বহুবছর যাবত সে চিকিৎসা করে আসছে।
“ আব্বাজান, আমরা আপনার কথামতো কাজ করেছি। বমিটা একটা কুকুরকে খেতে দিয়েছিলোম। আর খরগোসের মাংস আরেকটা কুকুরকে এবং সারারাত তাদের উপরে নজর রেখেছিলাম। প্রথম কুকুরটা অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ভয়ঙ্কর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়- ঠিক আপনার মতো- তারপরে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে। দ্বিতীয়টা নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকে এবং করুণ স্বরে ডাকতে থাকে, বেচারার পেট ফুলে উঠে। আমরা পাথর ছুঁড়ে তাকে মারলেও তাকে নড়াতে পারিনি বা একটা ডাকও তার গলা দিয়ে বের করতে পারিনি। তারপরে ঘণ্টাখানেক আগে-এই কুকুরটাও বমি করে এবং এখন ধীরে ধীরে চলেফিরে বেড়াচ্ছে। বিজ্ঞ হেকিমের দল সারারাত নিধুম কাটিয়েছে তাদের বইপুস্তক নিয়ে। তারা একমত হয়েছে যে, আপনার সাথে এই কুকুর দুটোর উপসর্গ নিঃসন্দেহে বিষ প্রয়োগের ফলাফল।