অন্য বাদ্যযন্ত্রীরা এবার বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যোগ দেয়। এসব বাদ্যযন্ত্র বাবর কখনও দেখেনি- বীণার মত দেখতে। কিন্তু মাথার দিকটা এক মিটার লম্বা। বাবর শুনেছে একে তানপুরা বলা হয়। আরেকটা তারের বাদ্যযন্ত্র যার উপরে নিচে দুটো বোল লাগানো এর নাম রুদ্রবীণা। আরেকটা বাঁশির মত যন্ত্র দেখতে অনেকটা ছোটখাট সূর্যের মতো দেখতে, একে বলে সানাই। বাবর অনুভব করে সাবলীল, তরুণী নাচিয়ে, ছন্দোবদ্ধ ঢোলের আওয়াজ, সুরেলা তন্ত্রীর মূচ্ছনা, আর সুরেলা কণ্ঠের উত্থানপতন সব মিলিয়ে পুরো নাচটার আবেদন তার নান্দনিকতার মতো কোনো কিছু তার মাতৃভূমিতে সে দেখেনি।
বেশ কিছুক্ষণ পরে বাবর বুঝতে পারে যে তার লোকদের রক্তে কাঁপন ধরিয়েছে বাঈজির দল, তারা এবার নাচতে শুরু করেছে। কেউ কেউ তাদের ছেড়ে আসা পাহাড় আর তৃণভূমির গান হেড়ে গলায় গাইতে শুরু করে। বাকিরা উঠে দাঁড়িয়ে হাত হাত আঁকড়ে বুনো উদ্দাম নাচ শুরু করে পা দিয়ে তাল ঠুকে উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে বিজয় আর আনন্দের মুহূর্ত উদযাপদ করতে থাকে। হুমায়ুন অনেকক্ষণ উসখুস করে শেষে সেও গিয়ে তাদের সাথে যোগ দেয়।
বাবর এসব এসব কিছু দেখে না। সে নিজের ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছে। সে বিজয়ের চেয়েও বড় কিছু একটা উদযাপন করছে। আজ রাতে তার জীবনের একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। যখন সে এতোদিন যা কিছু শিখেছে, যা কিছু অর্জন করেছে। সবকিছুকে একটা চূড়ান্ত রূপ দান করছে। কিন্তু উল্লাসের মাঝে একটা বিষাদের সুর ধ্বনিত হয়। এই ভোজসভায় আরেকজনেরও উপস্থিত থাকবার কথা ছিলো। সবকিছু উপভোগ করার কথা ছিলো তার সত্যিকারের বন্ধু এবং সবচেয়ে অভিজ্ঞ সেনাপতি। বাবর তার হাতের পানপাত্রটা তুলে নিয়ে সেই অনুপস্থিত বন্ধুর স্মরণে নিরবে একচুমুক পান করে।
৪.৫ প্রতিহিংসাপরায়ণ বুয়া
২৪. প্রতিহিংসাপরায়ণ বুয়া
শুক্রবারের এক সন্ধ্যাবেলা আগ্রা দূর্গের প্রকারবেষ্টিত পর্যবেক্ষণ বুরুজের বেষ্টনীর ভিতর থেকে দাঁড়িয়ে বাবর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশের গায়ে গাঢ় ধূসর, প্রায় বেগুনী মেঘের রাশি অবিরল ধারায় বৃষ্টি ধারা ঝরে পড়ছে। আঙ্গিনার শানবাঁধানো পাথরের উপরে বৃষ্টির ফোঁটা ছিটকে উঠে এবং বেলেপাথরের দেয়ালে কাটা গর্তের ভেতর দিয়ে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ছে। দূর্গের উত্তর আর পূর্বদিকের দেয়ালের ফোকড় গলে নীচ দিয়ে পূর্ণবেগে প্রবাহিত যমুনা নদীতে ঝর্ণাধারার মতো আছড়ে পড়ছে। দক্ষিণ আর পশ্চিম দিকে পানি জমে ইতিমধ্যে বিলে পরিণত হওয়া কুচকাওয়াজ ময়দানে নৃত্যরত ভঙ্গিতে গিয়ে জমা হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুচ্চমক নিচু হয়ে আসা, ধোঁয়াটে দিগন্তের বুকে আঁচড় কেটে দেয়। সাথে সাথে দূর থেকে বজ্রপাতের গুরুগম্ভীর ধ্বনি ভেসে আসে।
বাবর তাকিয়ে থাকার মাঝে টের পায় বাতাসে কেমন উষ্ণ আর আর্দ্রতার আতিশয্য। মধ্য এশিয়ায় বছরের এই সময়ে গ্রীষ্মকালে সূর্যের দাবদাহে অতিষ্ঠ হয়ে গরমের থেকে ভীষণ আলাদা। এখানে হিন্দুস্তানে বৃষ্টির কাল স্থানীয়রা যাকে মৌসুম বলে, ইতিমধ্যে তিন মাস স্থায়ী হয়েছে। সবকিছু স্যাঁতাসেতে করে তুলেছে। সুযোগ পেলে কাপড়চোপড় আর আসবাবপত্রও ক্ষয়কর ছত্রাকের প্রকোপ থেকে রেহাই পায় না। তাকে তার অমূল্য রোজনামচাও আগুনে শুকিয়ে নিতে হয় আর্দ্রতার হাত থেকে বাঁচবার জন্য। ধাতব আস্তরণ দেয়া সিন্দুকের ভেতরেও সেগুলো আর্দ্রতার প্রকোপ থেকে রেহাই পায় নাই।
যাই হোক, সে ভাবে, কিছুক্ষণের ভিতরেই নিজের কামরায় সে হুমায়ূনের সাথে আহারে বসবে। এটা অন্তত একটা সুসংবাদ- সে এই মুহূর্তে বেশি লোকের সঙ্গ পছন্দ করছে না। সে তার প্রধান রাঁধুনীকে নিজের প্রিয় পদ রান্না করতে বলেছে: কচি খরগোসের মাংস, অল্প আঁচে দারুচিনি, এলাচ আর কিশমিস দিয়ে রান্না করে পরিবেশনের আগে টকদই মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। সুলতান ইবরাহিমের হেশেল থেকে যে চারজন রাঁধুনিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সে তাদের বলেছে তার নতুন সাম্রাজ্যের স্বাদ উপস্থাপনকারী গুরুপাক মশলাযুক্ত, রসুন দেয়া পদ রান্না করতে। সে দ্রুত তাদের এই রান্নার ভক্ত হয়ে উঠছে। মুখরোচক খাবারের চিন্তা তার ক্রমাগত মাথাব্যাথা অনেকটাই দূর করে, যা এই বর্ষাকালে তাকে বেশ ভোগাচ্ছে। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বুরুজ থেকে নেমে নিজের কামড়ার দিকে হাঁটা দেয়।
হুমায়ুন ইতিমধ্যে ফিরোজা রঙের চাদরে ঢাকা আর রূপার খাবার পাত্র সজ্জিত বিশাল নিচু টেবিলের সামনে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে আছে। টেবিলের মধ্যেখানে একটা বিরাট বারকোশের উপরে মাখন দিয়ে রান্না করা পোলাও। যাতে নানা পদের বাদাম দেয়া হয়েছে। বাবর কামরার ভেতরে প্রবেশ করতে হুমায়ূন উঠে দাঁড়িয়ে তাকে আলিঙ্গন করে। বাবরের চেয়ে সামান্য লম্বা, সে ইতিমধ্যেই চওড়া আর পেশল দেহের অধিকারী হয়ে উঠেছে হিন্দুস্তান অভিযান তাকে পরিণত করে তুলেছে। বাবর মৃদু হেসে তাকে বসতে ইঙ্গিত করে। তারপরে হাততালি দিয়ে আপাদমস্তক সাদা পোশাক পরিহিত দুই পরিচারককে সে বাকি খাবার পরিবেশনের অনুমতি দেয়। নিমেষের ভিতরে তারা আরো চারজনকে নিয়ে ফিরে আসে, সবার হাতে কাপড়ে আবৃত বিশালাকৃতি ধাতব পাত্র। কাপড় সরিয়ে নিতে ঘরের ভেতরটা সুস্বাদু মশলার গন্ধে ভরে উঠে।