তাকে আর তার অতিথিদের পাঙ্খ দ্বারা, কারুকাজ করা রেশমের আয়তাকার টুকরো লম্বা রেশমের দড়ির সাহায্যে ঝুলছে। দড়িটা আবার ছাদে স্থাপিত একসারি লোহার রিঙের ভিতর দিয়ে গিয়ে দেয়ালের উঁচুতে স্থাপিত একটা ফোকর গলে বের হয়ে গিয়েছে। পাঙ্খ ওয়ালারা দেয়ালের ওপাশে যারা অবস্থান করছে, তাদের টানবার জন্য, যাতে খাবার সময়ে কাপড়ের টুকরোটা ধীরে ধীরে আহাররত অতিথিদের মাথার উপরে ধীরে ধীরে আন্দোলিত হয়ে তাদের শীতল রাখতে পারে। বাবরের দেয়াল বরাবর স্থাপিত নিচু টেবিলে ঝলসানো ভেড়ার মাংস, রান্না করা মুরগী এবং চাপাটি স্তূপ করে রাখা। সবই তাদের মাতৃভূমির খাবার। কিন্তু এর সাথে আরো রয়েছে হিন্দুস্তানের ফলমূল: কমলা রঙের আশযুক্ত আম, রসে টইটুম্বর, আর নরম রসালো পেঁপে আর খেজুর।
তার মতো অনেকেই তৈমূর আর চেঙ্গিস খানের বংশধর। সবাই তাকে দারুণ সাহায্য করেছে। ভোজ শুরু হবার আগে, সে সবার মাঝে উপহার বিতরণ করে লাল রেশমের খিলাত, স্যাবেলের চামড়ার তৈরি জ্যাকেট যার সামনের দিকটা নীল রঙের, রত্নখচিত খঞ্জর, তরবারি, কারুকাজ করা সোনার পর্যান। বাবর তাদের চোখেমুখে সন্তুষ্টির ছায়া দেখতে পায়। সে দেখে বাবা ইয়াসাভাল হাতলে পান্না খচিত একটা বাঁকানো তরবারির হাতল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে।
তারা খেতে শুরু করতে বাবর আড়চোখে একবার তার ডানপাশের পর্দার দিকে তাকায়। সাধারণত রাজকীয় ভোজসভার সময়ে রাজপরিবারের মেয়েরা তার পেছনে। অবস্থান করেন। এবং নিজেরা খেতে খেতে জাফরীর ওপাশে কি ঘটছে সেদিকে লক্ষ্য রাখেন। বুয়া কি নিজের কক্ষে বসে তার মৃত সন্তানের কামরা থেকে ভেসে আসা এই আনন্দ উল্লাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে? বাবর কামনা করে যেনো না পায়। তার সাহস আর দুঃখবোধ আর সেই সাথে রক্তের কারণে সে তাকে সম্মান করে। তিনি হুমায়ুনকে যেসব কটুবাক্য বলেছেন সেজন্য তাকে শাস্তি দেবার কোনো মানে। হয় না। বাবর নিহত হলে এবং তার সিংহাসন অন্য কেউ দখল করলে এসান। দৌলতও কি একই আচরণ করতেন না। সে আদেশ দিয়েছে যে বুয়া তার অলংকার এবং পরিচারিকাদের রাখতে পারবে এবং সে তার জন্য একটা ভাতার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। সে আশা করে সময়ের সাথে তার এই উদারতা তাকে প্রশমিত করবে।
সেদিন সকালের দিকে, নদীর তীরে, বাবর সুলতান ইবরাহিমের হাতিশালার দুটো মর্দা হাতির, যাদের নাম যথাক্রমে পর্বতবিদারক আর অনন্ত সাহসী, মাঝে লড়াই উপভোগ করে। বিশেষভাবে নির্মিত মাটির ঢালু পথের উপরে বিশাল রঙ করা জন্তুগুলোর কানের পেছনে বসে থাকা মাহুত তাদের পরস্পরের দিকে ধাবিত হতে উৎসাহিত করলে, তারা শুড় আন্দোলিত করে ঝাঁপিয়ে পড়ে লড়াই ততোক্ষণই চলে। যতোক্ষণ না একটা হাতি পিছুহটে আসে। তার ভিন্ন কিছু উপভোগের সময় আসে বাবর হাততালি দিয়ে ইবরাহিমের প্রাসাদের নিয়মিত দড়াবাজ আর বাঈজিদের আসতে ইঙ্গিত করে।
দু’জন তরুণ, তাদের তেলচকচকে দেহে কেবল কমলা রঙের নেংটি রয়েছে, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল মাথার উপরে চুড়ো করে বাঁধা বাবরের মঞ্চের সামনে পরিষ্কার করা। স্থানের দিকে দৌড়ে আসে। তারা দুজনে হলুদ রঙের একটা আয়তাকার বাক্স বয়ে আনে। বাক্সটা তিন ফিট লম্বা আঠার ইঞ্চি চওড়া এবং উভয়পাশে রহস্যময় একটা চোখ লাল রঙে আঁকা রয়েছে। তারা বাক্সটা রেখে চলে যায়। বাবরের লোকেরা। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে- বাক্সের ঢাকনিটা যেনো নিজে থেকেই খুলে যেতে শুরু করেছে। ভেতর থেকে একটা ছোট হাত বের হয়ে আসে। তারপরে আরেকটা এবং তারপরে এক ঝটকায় ঢাকনিটা পুরো খুলে গিয়ে ভেতর থেকে একটা ছেলে বের হয়ে আসে যার পা দুটো উল্টো করে কাঁধের উপরে আঁকড়ে রয়েছে। অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার যে কোনো মানুষের পক্ষে হোক না সেটা একটা বাচ্চা ছেলে নিশ্চিতভাবেই তার কোমরের কাছটা দু’ভাজ করা যায়- এত ছোট একটা স্থানে নিজেকে প্রবেশ করানো সম্ভব। নিজেকে বের করে এনে ছেলেটা বাক্স থেকে বের হয়ে দাঁড়ায় এবং অন্য দুই দড়াবাজ এবার তাদের কপালে, হাঁটুতে, হাতে আর পায়ের উপরে বল ঘোরাতে ঘোরাতে ঘরের ভিতরে ডিগবাজি খেতে থাকে। তাদের চিকন পা এতো দ্রুত আন্দোলিত হয় যে ঝাপসা একটা দৃশ্যকল্পের জন্ম হয়।
এরপরে একজন দড়াবাজ লাফিয়ে আরেকজনের কাঁধে উঠে পড়ে এবং ছেলেটা তারপরে আপেল গাছে উঠবার মতো অনায়াসে তাদের দেহ বেয়ে উঠে যায়। উপরের লোকটার মাথায় ভর দিয়ে সে নিজের মাথা পেছনের দিকে হেলিয়ে দিয়ে এবং মুখ থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুঁড়ে দেয়। বাবরের সেনাপতিরা চেঁচিয়ে নিজেদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। চোখের পলকে ছেলেটা আবার মাটিতে নেমে আসে। নিজেকে আবার গুটিয়ে নিয়ে সে বাক্সে ঢুকে পড়ে এবং বিদায় সম্ভাষণ জানাবার ভঙ্গিতে সে নিজেই বাক্সের ঢাকনিটা বন্ধ করে দেয়। বাকি দুজন দড়াবাজ বাবরের সামনে মাথা নত করে সম্মান জানালে সে তাদের দিকে সোনার মোহর ছুঁড়ে দেয়। তারপরে তারা বাক্সটা তুলে নিয়ে তুমুল হাততালির ভিতরে কামরা ত্যাগ করে।
ধিনিক তাতা আওয়াজ আর ছন্দোবদ্ধ পদাঘাতে নিজেদের আগমন ঘোষণা করে। পরিচারকদের প্রবেশের দরজা দিয়ে খালি পায়ে আটজন মেয়ে নাচতে নাচতে কামরায় প্রবেশ করে। আরেকটা প্রবেশ পথ দিয়ে বাদ্যযন্ত্রীর দল প্রবেশ করে। মেয়েরা বাবরের সামনে একটা বৃত্ত তৈরি করে। তাদের ঘন কালো চুল মিষ্টি গন্ধযুক্ত সাদা ফুল দিয়ে বেণী করে বাঁধা। লাল আর বেগুনী রঙের অনেক স্তর বিশিষ্ট ঘাঘড়ার উপরে তাদের উদরের অংশটা নগ্ন। আঁটসাঁটো রেশমের কাচুলি তাদের স্তনের অধিকাংশই ঢেকে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে এবং তাদের কব্জি আর পায়ের গোড়ালীতে ছোট ছোট ঘণ্টা সারিবদ্ধভাবে আটকানো। ঢোলা সাদা পাজামা আর বুক ভোলা সোনালী রঙের আটসাট বান্ডি পরিহিত ছয়জন বাদকের দল তাদের গলা। থেকে ঝোলানো সরু ঢোলে হাত দিয়ে বাড়ি দিতে দিতে তালে তালে দুলতে আর লাফাতে থাকে। বাঈজি মেয়েদের দেহ বাজনার সাথে সাথে আন্দোলিত হতে শুরু করে। শীঘ্রই তারা দ্রুত গতিতে ঘুরতে থাকে, ঘাঘড়া উঠে গিয়ে তাদের সুন্দর সুগঠিত পা উন্মুক্ত করে তুলে, আর হাত হেলান মাথার পিছনে দেয়া। নাচের তালে তালে তারা গান গাইতে থাকে। তাদের সুরেলা কিন্নরী কণ্ঠ ঢেউয়ের মতো উঠতে আর নামতে থাকে।