“আব্বাজান আমার আছে।” হুমায়ূন তার বাদামী চোখে অপলক দৃষ্টিতে বাবরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে।
“তাহলে আমরা ব্যর্থ হবো না, আমি এই বিষয়ে নিশ্চিত। আমি আমাদের নতুন সাম্রাজ্য আর ভূখণ্ডের জন্য একটা নাম পছন্দ করেছি। দিল্লী আসবার পথে, পারস্যের শাহের লেখা একটা অবিবেচক বার্তা আমার হস্তগত হয়। বার্তাটা আমাদের পানিপথের বিজয় অর্জনের আগে লিখিত হয়েছিলো। তিনি তাতে লিখেছেন যে আমার অভিযানের কথা তিনি শুনেছেন তিনি একে ‘তস্করদের হামলা’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আমাকে ‘মোঘল’ নামে অভিহিত করেছেন বার্তাটায়- ফার্সীতে শব্দটার মানে মোঙ্গল’- আমাকে অসভ্য হানাদার হিসাবে অপমান করার অভিপ্রায়ে। কিন্তু আমি তাকে লিখে পাঠাই যে চেঙ্গিস খানের, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মোঙ্গলের, বংশধর হিসাবে, যেমন আমি গর্ববোধ করি, তেমনি তৈমূরের বংশধর হিসাবেও আমি গর্বিত। মোঙ্গল’ সম্বোধনের ভিতরে কোনো অপমান নেই। আমি তাকে বলেছি যে আমি গর্বের সাথে এই সম্বোধনটা ধারণ করবো। আর আল্লাহতা’লার কৃপায় শীঘ্রই আমাদের নতুন সাম্রাজ্য তার নিজের সাম্রাজ্যকেও আকার আর সমৃদ্ধিতে ছাড়িয়ে যাবে।”
***
উদ্যত আনুষ্ঠানিক তরবারি হাতে দুই প্রহরীর পেছনে বাবর ধীরে ধীরে সোনার কারুকাজ করা চামড়া দিয়ে মোড়া দুই দরজাবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারের দিকে এগিয়ে যায়। যা সুলতান ইবরাহিমের কামরা থেকে দরবার কক্ষে প্রবেশের একান্ত প্রবেশপথ। যেখানে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য আয়োজিত ভূড়িভোজে অংশ নেবার জন্য তার সেনাপতিরা তার জন্য অপেক্ষা করছে। তার লোকেরা ইতিমধ্যে নদীর তীর বরাবর স্থাপিত তাঁবুগুলোতে আর নিচের আঙ্গিনায় উৎসব আরম্ভ করেছে। যুদ্ধে জয়লাভে সাহায্য করেছে এমন একজনও আজ রাতে বঞ্চিত হবে না।
মশালের আলোতে বাবরের পাগড়িতে সংবদ্ধ পান্না থেকে আলো ঠিকরে আসে। তার গলায় আরও মূল্যবান পান্নার সাথে মাঝে মাঝে মুক্তা দেয়া তিনছড়া বিশিষ্ট একটা মালা ঝুলছে এবং তার হাতে অবশ্যই তৈমূরের অঙ্গুরীয় শোভা পায়। তার জরির কারুকাজ করা সবুজ জোব্বাটা একপাশে মুক্তার ছড়া দিয়ে বাঁধা এবং একটা ভারী সোনার চেনের সাথে আটকানো আলমগীর তার কোমরে ঝুলছে। কয়েক মিনিট আগে নিজের ঝকঝকে অবয়বের দিকে সে সন্তুষ্ট চিত্তে তাকিয়ে ছিলো ক্ষমতা আর জৌলুসের মূর্তিমান প্রতিভূ।
তূর্যনাদের সাথে পরিচারকের দল দরজা খুলে দেয় এবং বাবর ভেতরে প্রবেশ করে। সাথে সাথে ভেতরে পিনপতন নিরবতা নেমে আসে। তার চৌকষভাবে সজ্জিত সেনাপতির দল মাটিতে শুয়ে পড়ে প্রথামাফিক আনুগত্য প্রকাশ কুর্নিশে আনত হয়। বাবরের ঠিক সামনে কামরাটার ঠিক মধ্যেখানে একটা স্তরবিশিষ্ট সাদা মার্বেলের বেদী দেখা যায়। একদম উপরের স্তরে সবুজ আর হলুদ চাদোয়ার নিচে রত্নখচিত সোনালী সিংহাসন শোভা পায়। তার সেনাপতিরা মঞ্চের সামনে সারিবদ্ধ অবস্থায় প্রণত হয়ে থাকে। বাবর তাদের মাঝ দিয়ে মাথা উঁচু করে, পিঠ সোজা রেখে, মঞ্চে আরোহন করে এবং নির্ধারিত আসনে উপবিষ্ট হয় এবং হুমায়ূনকে এক স্তর নিচে তার ডান পাশে নীল মখমলের একটা আসনে ইঙ্গিতে বসতে বলে।
“আপনারা এবার উঠে দাঁড়াতে পারেন।” সবার চোখ আবার নিজের উপর অনুভব না করা পর্যন্ত বাবর চুপ করে থাকে। “মহান আল্লাহতালা পানিপথে আমাদের প্রতি বিশেষ মেহেরবান ছিলেন। তিনি আমাদের বিজয়ী করেছেন। কারণ আমাদের যুদ্ধের কারণ ন্যায়সঙ্গত ছিল। হিন্দুস্তানের সিংহাসনে আমাদের জন্মগত অধিকার। সুলতান ইবরাহিম আমাদের বাধা দিতে চেষ্টা করে যুদ্ধে মারা গেছেন। আমরা সবাই আমার সব সেনাপতি, যারা আমাকে আগুন আর পানির মাঝ দিয়ে অনুসরণ করে এসেছেন। সবাই বিজয়ী। আমাদের ইতিহাসের এটা একটা নতুন অধ্যায়। আমার লোকদের নতুন নিয়তি যখন আমরা নিজেদের হিন্দুস্তানের প্রভু প্রতিপন্ন করেছি। কিন্তু এখনও আরও মহান গৌরব আমাদের সামনে হাতছানি দিচ্ছে। কিন্তু আজ রাতে আমরা সবকিছু ভুলে গিয়ে কেবল আমাদের বিজয়ের মধুর স্বাদ উপভোগ করবো…” বাবর উঠে দাঁড়িয়ে এক হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে মাথার উপরে তুলে ধরে এবং চিৎকার করে উঠলে, “আমাদের নতুন সাম্রাজ্যের উদ্দেশ্যে!” তার চারপাশে সম্মতির একটা গমগম আওয়াজ দরবারের দেয়াল ভেদ করে ছড়িয়ে পড়তে চায়।
সুলতান ইবরাহিম বেশ সৌখিন জীবনযাপন করতেন। কিছুক্ষণ পরে বাবর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চারপাশে তাকিয়ে ভাবে। নিখুঁতভাবে খোদাই করা লাল বেলেপাথরের স্তম্ভ, মাঝের ক্ষুদ্র গম্বুজ, লালচে-গোলাপী সিল্কের পর্দায় শোভিত এই কামরাটার মতো চমকপ্রদ কিছু সমরকন্দের বাইরে সে দেখেনি। মঞ্চের দুপাশে ময়ূরের মতো দেখতে দুটো সোনালী রঙের লম্বা ধূপদানি থেকে সুগন্ধি ধোয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে আসছে। ময়ুর দুটোর ছড়ানো পেখমে আবার পান্না আর নীলার কারুকাজ করা। বাবরের ডানপাশে একটা কারুকাজ করা চন্দনকাঠের বেষ্টনী পার্শ্ববর্তী হারেমকে দরবার থেকে পৃথক করেছে।
বাবর আর তার পরিশ্রান্ত বাহিনীর আগ্রায় আগমনের পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত বাতাস বইতে শুরু- সম্ভবত বৃষ্টি শুরু হবার আগে এমনই বাতাস বয়, অথবা এটা তাদের সৌভাগ্য। বাবর ঝুলন্ত রেশমের পর্দা মৃদু ভঙ্গিতে আন্দোলিত হতে দেখে।