“যুদ্ধের উপকরণ ছাড়া বিজয় ও সাম্রাজ্য অর্জন সম্ভব না। রাজপদ ও আমীর রঈস অধীনস্ত রাজা-প্রজা ছাড়া টিকতে পারে না। বহু বছরের সাধনায় বহু দুঃখ-কষ্ট সয়ে, বহু বিপদের সম্মুখীন হয়ে, বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে আমরা এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। বুকের রক্ত দিয়ে যে সাফল্য আমরা অর্জন করেছি আজ কি এমন অঘটন ঘটেছে যে সেই পরম আরাধ্য বিজয় হেলায় ফেলে রেখে আমরা দেশে ফিরে যেতে এতো ব্যস্ত হয়ে উঠেছি? আমরা কি তবে মহত্ত্ব অর্জনের যোগ্য নই…” বাবর একটু থামে অপেক্ষা করে সময় দেয় কথাগুলো তাদের মর্মমূলে প্রবেশ করার। “যে কেউ চাইলে তার প্রাপ্য অংশ নিয়ে সিন্ধু অতিক্রম করে দেশে ফিরে যেতে পারে। আমি একটা কথা বলে রাখছি। যখন বৃদ্ধ অবস্থায় নাতি নাতনি পরিবেষ্টিত হয়ে আগুনের পাশে বসে থাকবে এবং তারা যখন তোমার কাছে জানতে চাইবে কি দুর্ধর্ষ যোদ্ধা তুমি ছিলে। তখন দেখবে বলার মতো কিছুই তোমার থলেতে জমা নেই। তুমি লজ্জিত হবে বলতে যে, তোমার সুলতানকে তুমি ত্যাগ করেছিলে- না, তোমার সম্রাটকে- যে তোমাদের সুযোগ দিয়েছিলো বিশ্ব জয় করার…তুমি তখন মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকবে। আর তোমার নাতি নাতনিরা তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে…”।
চোখে অস্বস্তি নিয়ে সেনাপতিরা একে অন্যের দিকে তাকায় এবং কিছুক্ষণ পুরো জটলাটায় নিরবতা বিরাজ করে। তারপরে বাবা ইয়াসাভালের নেতৃত্বে, একটা গুনগুনে গুঞ্জন শুরু হয়। এমন একটা গুঞ্জন ফারগানায় কিশোর সুলতান হিসাবে সেই দিনগুলোর পরে সে আর কখনও শোনেনিঃ “বাবর মির্জা! বাবর মির্জা!” গুঞ্জনটা ক্রমেই জোরালো হতে থাকে, ভারী বাতাস মথিত করে। তারা তৈমূরের উত্তরসূরী আর নিজেদের সুলতান হিসাবে তার প্রতি তাদের আনুগত্য ঘোষণা করছে। তারা তাকে ছেড়ে যাবে না। অন্তত এখনই না।
*
নিজের সেনাপতিদের পেছনে নিয়ে হুমায়ূন দূর্গপ্রাঙ্গনে তার জন্য অপেক্ষা করেছিলো। কয়েকদিন পরে যখন বাবর ঢালু পথটা দিয়ে শক্তিশালী আগ্রা দূর্গে প্রবেশ করে। সে ঘোড়া থেকে নামতে তার ছেলে আনুষ্ঠানিকভাবে তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে। কিন্তু বাবর সাথে সাথে তাকে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে।
“আব্বাজান, কোষাগার সুরক্ষিত রয়েছে। হারেমে আমরা সুলতান ইবরাহিমের মা বুয়া, তার স্ত্রী আর উপপত্নীদের পেয়েছি। বুয়া আমাদের বর্বর বলেছে- সে বলেছে সে আমাদের ঘৃণা করে…” আমি তার অপমানজনক কথাবার্তা আমলে না নিয়ে তাকে আর হারেমের অন্য বাসিন্দাদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে বলেছি…স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে কোনো প্রতিরোধের আমরা সম্মুখীন হইনি। বস্তুতপক্ষে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে তারা বরং স্বস্তির শ্বাস নিয়েছে। প্রথম যখন খবর আসে যে আপনার কাছে সুলতান ইবরাহিম পরাস্ত হয়েছে। ডাকাতের দল অবস্থার সুযোগ নিয়ে চেষ্টা করেছে গ্রামে লুটতরাজ চালাবার। তাদের মেয়ে, শস্য আর ভেড়ার পাল চুরি চেষ্টা করেছে। আমাদের হাতে কিছু ধরা পড়তে আমরা তাদের প্রকাশ্যে প্রাণদণ্ড দেই। এখানেই ঐ কুচকাওয়াজ ময়দানে, দূর্গের সকল অংশ থেকে যেনো সবাই ফাঁসি দেয়াটা দেখতে পায়।
“তুমি দারুণ কাজ দেখিয়েছে। রাজকোষে কি খুঁজে পেলে?”
হুমায়ুনের কান পর্যন্ত হাসিতে ভরে উঠে। “আমি কখনও এমন কিছু দেখিনি সবগুলো সিন্দুকই সোনার মোহর আর দামী পাথরে পরিপূর্ণ…এতো পাথর রয়েছে। যে আমার বিশ্বাসই হতে চায়নি যে পৃথিবীর মাটি খুঁড়ে এতো পাথর বের করা সম্ভব। সবকিছুর হিসাব নিয়ে নথীবদ্ধ করে ওজন করা হয়েছে…”
“বেশ। আমি কাবুলে আমার লোকদের তাহলে অকৃপণ হাতে উৎসব করার জন্য দান করতে পারবো। কয়েক দিনের ভিতরে আমরা বিজয় উপলক্ষে একটা ভূড়িভোজের আয়োজন করবে। কিন্তু তার আগে আপনাদের সাথে আমি কিছু আলোচনা করতে চাই এবং কিছু বিষয় জানতে চাই আপনাদের কাছে। দিল্লী আসবার পথে আমি ভাববার অনেক সময় পেয়েছি…আমাদের মতো আরো অনেক মহান যোদ্ধা, যারা হিন্দুস্তানে এসেছিলো আমি তাদের কথা ভেবেছি মেসেডোনিয়ার সিকান্দার, যিনি সিন্ধু অতিক্রম করে তার বাহিনী নিয়ে এপারে এসেছিলো কিন্তু পরে ফিরে যায় এবং তৈমূর যিনি দিল্লী আক্রমণ করেছিলেন কিন্তু সেখানে অবস্থান করেননি…আমি ভাবছি আমরা এখানে উন্নতি করতে পারবো কিনা…আমার অনেক সেনাপতি যাদের সাহস প্রশ্নাতীত। কিন্তু তাদের মনেও এই একই প্রশ্ন উদয় হতে শুরু করেছে…তারা এই অঞ্চলটা পছন্দ করছে না…আমরা এইসব সম্পদ মালবাহী খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারি। কিন্তু আমরা যদি এখানে অবস্থান করি তাহলে অনেক বিপদ আর সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।
“পানিপথে আমরা বিশাল বিজয় অর্জন করেছি কিন্তু সেটা ছিলো কেবল সূচনা। এই অঞ্চলের কেবল সামান্য অংশ আমরা দখল করেছি- সত্যি বলতে দুইশ মাইল চওড়া এক ফালি ভূখণ্ডের চেয়ে বেশি কিছু না। যদিও এলাকাটা খাইবার গিরিপথ থেকে হাজার মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। পানিপথের যুদ্ধের পরে আমরা তেমন কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন হইনি। কিন্তু তার কারণ অন্য কিছু না হিন্দুস্তানের বাকি সব ক্ষমতাবান নৃপতিরা নিজেদের শক্তিশালী দূর্গে ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে। তারা আমাদের বর্বর ডাকাতের দল বলে ভেবেছে যাযাবরের দল। যাদের শাসন ভোরের সূর্যালোকে শিশির বিন্দুর মতো উবে যাবে। তারা ইতিমধ্যেই আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিকল্পনার সাথে এখান থেকে আমাদের বিতাড়নের পাঁয়তারা কষতে শুরু করেছে। আজ আমি সবার সামনে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। আমাদের কি যুদ্ধে পর যুদ্ধ করার মানসিকতা রয়েছে, যার ফলে এক সময়ে আমরা নিজেদের এখানে নিরাপদ বলে মনে করতে পারি। আমার মতো এখানে উপস্থিত সবার ভিতরে সেই ইচ্ছা সেই দৃঢ়তা কি আছে?”