আরো কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে লিখে।
হিন্দুস্তানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল দেশটার বিশালত্ব। সেই সাথে সোনা আর অন্য সম্পদের প্রাচুর্য…
একজন মানুষ ইচ্ছা করলে অনেক কিছুই এখানে করা সম্ভব…
*
দক্ষিণ-পূর্বদিকে ক্রমাগত অগ্রসর হওয়া অব্যাহত থাকলে বাবরের মেজাজ কিছুটা প্রফুল্ল হয়। সে এবার লক্ষ্য করে যে দেশটা সে যতটা বিরাণ ভেবেছিলো ততোটা বিরাণ না। শুষ্কতা আর উষ্ণ বাতাস সত্ত্বেও, এখানে দারুণ সব ফুল ফোটে, যেমন ডালিম ফুলের চেয়ে গাঢ় লাল রঙের গুদাল, এবং পীচ ফুলের মতো পাঁচ পাপড়িযুক্ত মৃদু কিন্তু অপূর্ব গন্ধযুক্ত করবী।
তার এই নতুন আশাবাদী মনোভাবের সাথে আরেকটা ভাবনা তাকে চিন্তিত করে তোলে- সে যদি সত্যিই নিজেকে এখানে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়- তাকে তাহলে এই নতুন দেশ আর তার রীতিনীতি বোঝার চেষ্টা করতে হবে। দোভাষী জুনায়েদ বারলাসের সহায়তায় সে রাস্তায় যাকে দেখতে পায় তাকেই ডেকে প্রশ্ন করতে শুরু করে। যা দেখে সে বিষয়ে কৃষক বা বণিককে প্রশ্ন করে। একদিন সে একটা জলাধারের উপরে রাখা একটা পিতলের তৈরি দুই আঙ্গুল পুরু বাসনে মস্তুর দিয়ে বেগুনী পাগড়ী পরিহিত এক লোকতে বাড়ি দিতে দেখে। সে জানতে পারে এদের বলা হয় ঘড়িয়ালী- সময়রক্ষক। বাবরের মাতৃভূমিতে প্রতিদিন চব্বিশ ঘণ্টায় বিভক্ত আর প্রতি ঘণ্টায় আছে ষাট মিনিট। কিন্তু সে খেয়াল করে দেখে হিন্দুস্তানে তার। নতুন প্রজারা দিনরাতকে ষাটটা অংশে–ঘড়িতে বিভক্ত করেছে, চব্বিশ মিনিটে এক ঘড়ি, দিনরাতে রয়েছে চারটা সময়ভাগ যাকে বলা হয় প্রহর। ঘড়িয়ালদের কাছে এক ধরণের পাত্র আছে যার নিচে ছিদ্র করা। প্রতিঘণ্টায় এটা পানিতে ভর্তি করা হয়। ঘড়িয়ালী এই পাত্রের পানির উপর নজর রাখে। পাত্র ভরা মাত্র সে ঘড়িয়ালের উপরে কাঠের ছোট মস্তুর দিয়ে বাড়ি দেয়, ক্রমে পানি পড়া শেষ হয়ে যায়। তারপরে পাত্রে আবার পানি দেয় এবং ঘড়িয়ালে বাড়ি দেয়। রাতের প্রথম প্রহর শেষ হলে ঘড়িয়ালী খুব দ্রুত কয়েকটা বাড়ি দিয়ে শেষে জোরে একটা বাড়ি দেয়। রাত দুই প্রহর হলে একইভাবে দ্রুত কয়েকটা আঘাত করে জোরে দুটা বাড়ি দেয়। এভাবে তিন প্রহর আর চার প্রহর ঘোষণা করা হয়।
একজন অর্থ-ব্যবসায়ীর কাছে থেকে বাবর বাজারে মুদ্রাগণনা হিসাব পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পায় হিন্দুস্তানীদের হিসাব করার সুস্পষ্ট নিয়ম আছে: একশ হাজারে তাদের এক লাখ; একশ লাখে এক কোটি; একশ কোটিতে এক অর্ব এভাবে গণনার মাত্রা বাড়তে থাকে। কাবুলে গণনার জন্য তাদের এমন সংখ্যারীতির প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু হিন্দুস্তানে, যেখানে সম্পদ- অন্তত তার শাসকদের কাছে মাত্রাহীন, সেখানে এটা চালু আছে। ভাবনাটা বেশ প্রীতিকর।
বাবর কৃষকদের শ্রমসাধ্য প্রয়াসে তাদের কৃষিজমিতে সেচ দিতে দেখে। কুঁয়ো থেকে ষাড় দিয়ে চামড়ার মশকে পানি টেনে উপরে তোলা হয় এবং খেজুর আর তাল গাছের মিষ্টি মাদকতাময় পানীয় সে পান করেছে, তাল গাছ সে আগে কখনও দেখেনি। সে সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করে হিন্দুস্তানের ধর্মের সারবস্তু বুঝতে। জানতে পারে হিন্দুরা পূর্ণজন্মে বিশ্বাস করে এবং তাদের ভীতিকর দেখতে অসংখ্য দেবতা যাদের ভিতরে বহুভূজা নারী রয়েছে। নরমুণ্ডে সজ্জিত রয়েছে জালার মতো পেটের হাতির মুখঅলা দেবতা- সবাই আসলে একটা কেন্দ্রীয় ত্রিমূর্তির বহিপ্রকাশ, ব্রহ্মা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা; বিষ্ণু, ভারসাম্যের দেবতা আর শিব ধ্বংসের প্রতিভূ। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই কেমন ঘোলাটে, বিভ্রান্তকর আর কেমন বিব্রতকর। সুলতান ইবরাহিম তার মতোই একজন মুসলমান- এসব থেকে কি বুঝেছিলেন? বাবর আবার সেই মন্দিরের পুরোহিতের কথা ভাবে: “আমিই সেই ধ্বংসকারী…”।
সে শীঘ্রই আবিষ্কার করে যে কেবল তার কাছেই হিন্দুস্তান বিব্রতকর বলে প্রতিয়মান হয়নি। একরাতে তাঁবুর বাইরে বাতাসের আশায় বসে আছে সে, বাবা ইয়াসাভালকে এগিয়ে আসতে দেখে।
“সুলতান।” তার সেনাপতি হাত দিয়ে বুক স্পর্শ করে ভক্তি প্রদর্শনপূর্বক দাঁড়িয়ে থাকে।
“কি ব্যাপার?”
বাবা ইয়াসাভালকে ইতস্তত করতে দেখা যায়।
“বলো।”
“সুলতান আমার লোকেরা অস্থির হয়ে উঠেছে…এই নতুন অঞ্চলটা তারা একেবারেই পছন্দ করছে না…এতো গরম আর বিরামহীন বাতাস এখানে…অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে…” সে দম নেবার জন্য থামে, তার মশার কামড়ে দগদগে মুখটা মশালের আলোতে চকচক করে। “আমরা কাপুরুষ নই যুদ্ধে কখনও আমরা পিছপা হই না। কিন্তু এই এলাকাটা আমাদের কাছে অপরিচিত…আমরা কাবুলে ফিরে যেতে চাই। আমি কেবল আমার নিজের কথাই বলছি না, অন্য সেনাপতিদের তরফ থেকে আমি কথা বলছি। তারা তাদের পক্ষ হয়ে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে আপনার সাথে কথা বলতে।”
“সবাইকে এখনই এখানে আসতে বলো।”
বাবা ইয়াসাভাল নিজের মনে কথাই বলেছে। কয়েকদিন আগে বাবরের মনেও এই সব কথাই খেলা করতো। কিন্তু অন্য মানুষের মুখে নিজের মনের কথা উচ্চারিত হতে দেখে সে টের পায় কি গভীরভাবে সে যা দখল করেছে সেটা নিজের অধিকারে রাখতে চায়। অপেক্ষা করার সময়টায় সে মনে মনে গুছিয়ে নেয় কি বলবে। সেনাপতিরা তার তাঁবুর সামনে জড়ো হতে, কেউ কেউ তার চোখের দিকে সরাসরি তাকানো থেকে বিরত থাকে। সে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ধীরে ধীরে কথা বলতে থাকে।