বাবর শহরে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করে না- জুম্মা মসজিদে তার নামে খুতবা পড়ানো শেষ হতে সে শাহী কোষাগার পরিদর্শন করে। মণিমুক্তো আর মোহর ভর্তি সিন্দুকগুলো তার হিন্দুস্তানের অভিযানের সার্থকতা প্রতিপন্ন করে। অবশ্য দিল্লীতে ইবরাহিমের প্রাক্তন পরিচারকের ভীতসন্ত্রস্ত দল- বাবরের সামনে তাদের হাজির করা হলে- বাবরের ভাবনার সাথে তাল মিলিয়ে ব্যগ্র কণ্ঠে নিজেরাই বলে উঠে মূল কোষাগার আগ্রায় অবস্থিত। সে হুমায়ুনকে সেখানে পাঠিয়ে ভালোই করেছে। কোষাগারের হিসাব নেবার পরে নিজের একজন সেনাপতিকে শহরের নতুন শাসক হিসাবে নিয়োগ করে আগ্রায় হুমায়ুনের সাথে যোগ দেবার জন্য সে যমুনার তীর বরাবর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রওয়ানা দেয়।
আবহাওয়ায় উষ্ণতা এতো বেশি যে বাবর অবাক হয় এই গরমে জীবিত কিছু চলাফেরা করে কি করে। অবশ্য তার যাত্রা অব্যাহত থাকলে ধীরে ধীরে লোকজন দেখতে পাওয়া যায়। শীঘ্রই রাস্তাঘাট আর মাঠে তাদের নির্ভীকভাবে চলাফেলা করতে আর তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। সে যে কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা আরোপ করেছে তার প্রভাব নিশ্চয়ই পড়েছে…তার নতুন প্রজারা- ছেলেদের পরনে নেংটির মতো কাপড় আর মেয়েদের পরনে রঙচঙে লম্বা কাপড় তাদের শরীরে পেচিয়ে মাথার উপর গিয়ে শেষ হয়েছে। আর কপালে লাল চিহ্ন আর নাকে সোনার নাকফুল- তাদের নিশ্চিতভাবেই ভীত মনে হয় না। সূর্যের দাবদাহে ঝলসে যাওয়া গ্রামের ভিতর দিয়ে বাবর তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে তারা কৌতূহলী ভঙ্গিতে চারপাশে এসে ভীড় করে। গ্রামগুলোতে শুকনো গোবর, মশলা আর ধূপের মিষ্টি সুগন্ধে ভরা। তারা বস্তা ভর্তি শস্য, ফলমূল আর সজি নিয়ে এসে বাবরের সৈন্যদের কাছে বিক্রিও করে।
দিন অতিক্রম করার সাথে সাথে সূর্যের অবিরাম আলোর নিচে সমতল, খয়েরী আর শুষ্ক ভূপ্রকৃতি আর তার গিজগিজ করতে থাকা লোকের ভীড় বাবরকে অস্থির করে তোলে। প্রাণশক্তি আর উদ্যমের অভাব সে অনুভব করতে থাকে। রাতের বেলাতেও স্বস্তি নেই। তখন শুরু হয় মশার গুঞ্জন এবং তার পরিচারকের দল শীতের দেশের জন্য নির্মিত তাঁবু আবহাওয়া কিছুতেই শীতল করতে পারে না। মন্থরগতি যমুনাও তার চোখকে বিন্দুমাত্র আনন্দ দিতে ব্যর্থ হয়। যমুনার তীরের শুকনো জমাট কাদার দিকে তাকিয়ে সিন্ধু নদের ওপাশে নিজের দেশের খরস্রোতা নদী আর বলকারী বাতাসের জন্য তার মনটা আনচান করতে থাকে।
ষষ্ঠদিন সন্ধ্যাবেলা। কাবুল থেকে আগত এক বার্তাবাহক একটা উপহার নিয়ে উপস্থিত হয়। ধাতব আস্তরণ দেয়া কাঠের বাক্সটার ভেতরে, যাত্রার শুরুতে নিশ্চিতভাবেই বরফ দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছিলো। সে দেখে তরমুজ রয়েছে, খানজাদা তার প্রিয় ফল পাঠিয়েছে। নিজের তাঁবুর ভেতরে একাকী বসে সে তরমুজটা কেটে সেটার রসাল মিষ্টি শাশের স্বাদ নিতে তার চোখ জ্বালা করতে থাকে। নিজের দেশত্যাগের অনুভূতি তার ভিতরে প্রবল হয়ে উঠে। খানজাদা তাকে সামান্য আনন্দ দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু তার পাঠানো উপহার কেবল তাকে আরও নিঃসঙ্গ করে তোলে।
বাবর হাত বাড়িয়ে কালি, কলম আর রোজনামচার খাতা তুলে নেয়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সে লেখার সময়ই পায়নি। বাবর লিখতে শুরু করে:
হিন্দুস্তান দেশটায় কোনো বৈচিত্র নেই। এখানকার লোকজনও দেখতে সুদর্শন না…এখানে ভালো ঘোড়া, বা শিকারী কুকুর, মাংস, আঙ্গুর, সুস্বাদু তরমুজ বা অন্য কোনো স্বাদু ফল পাওয়া যায় না। এখানে নেই কোনো বরফের বা শীতল পানির বন্দোবস্ত। বা বাজারেও ভালোকিছু জিনিসের বড় অভাব। গরম পানির হাম্মাম বা মাদ্রাসাও নেই। তাদের নদী বা ছোট স্রোতস্বিনী, যেগুলো গিরিন্দর দিয়ে প্রবাহিত, এখানের বাগানে বা বাসস্থানে পানি প্রবাহের কোনো বন্দোবস্ত নেই…
সে লেখা থামায়। বাবুরী যে তাকে হিন্দুস্তান বিজয়ী উপাত্ত এনে দিয়েছিলো সে। তাকে কি বলতো? সে এই মাত্র যা লিখেছে তাতে কেবলই তিক্ততা আর ছিদ্রান্বেষণের অভিপ্রায় প্রকট। যেকোনো ধরণের আত্ম-করুণার লক্ষণের প্রতি বাবুরীর ছিল চরম বিতৃষ্ণা এবং শীঘ্রই সে এই লক্ষণ খুঁজে পেতো। সে থাকলে বাবরকে হয়তো বলতো এটা থেকে বের হয়ে আসতে…বলতো সে একটা দারুণ সুযোগ পেয়েছে এবং তার দায়িত্ব হলো এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। কিন্তু সম্ভবত বাবুরী এখন তার সাথে থাকলে সে হয়তো এমন বিষণ্ণ বোধ করতো না…।
নিজের জোব্বার ভেতর হাত ঢুকিয়েসে নরম চামড়ার থলিতে বন্দি কোহ-ই-নূর, আলোর পর্বত বের করে। তাবুর আধো আলোতেও পাথরটা চমকাতে থাকে। এই নতুন দেশের শক্তিশালী প্রতীক, যা তার মাঝে শক্তি আর প্রতিজ্ঞার নব ফরুধারা প্রবাহিত করছে। আক্ষেপ করার সময় এটা নয়। হিন্দুস্তান যদি সে যেমন দেশ পছন্দ করে তেমনটা না হয়েও থাকে, তবে সে আর তার সন্তানেরা তাকে তাদের মনের মতো দেশে পরিণত করবে। তারা এমন একটা সাম্রাজ্যের জন্ম দেবে যা নিয়ে মানুষ সম্ভ্রমের সাথে শতাব্দির পরে শতাব্দি আলোচনা করবে।
ডায়েরীর একটা নতুন পাতা খুলে বাবর আবার লিখতে শুরু করে:
কাবুলে আমি যখন প্রথমবার আসি সেই বছর থেকে আমি মনে মনে কেবল হিন্দুস্তানের জপ করেছি। এখন আল্লাহতালার পরম করুণায়, আমি পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষ সুলতান ইবরাহিমকে পরাস্ত করেছি এবং আমার সাম্রাজ্যের জন্য একটা নতুন রাজত্ব জয় করেছি।