বারান্দায় ধারণ করে থাকা বেলেপাথরের স্তম্ভে আরও সুগঠিত দেহের মূর্তি খোদাই করা রয়েছে- চার, ছয় কি আট হাতবিশিষ্ট। আঙ্গিনার একপাশে একটা সাদা পাথরের হাঁটু মুড়ে বসে থাকা ষাঁড়ের মূর্তি। গলায় গাঁদা ফুলের মালা ঝুলছে। আর সামনে রাখা পিতলের ধূপদানে ধূপ পোড়ার গন্ধ আসছে। কাছেই একটা মামুলি কালো পাথরের- সম্ভবত কষ্টিপাথর- স্তম্ভের চারপাশে মোমবাতি জ্বালানো রয়েছে যার উপরের দিকটা গোলাকার এবং কিছু কিছু স্থান এমন মসৃণ যে পাথরটা মার্বেলের দীপ্তি ছড়াচ্ছে। স্তম্ভটার সামনে তেল, খাবার আর পদ্মফুলের নৈবেদ্য সাজান রয়েছে।
“ওটা কি?” বাবর জানতে চায়।
জুনায়েদ বারলাস পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু স্পষ্টতই বোঝা যায় উত্তরটা বুঝতে তার নিজেরই কষ্ট হচ্ছে। অবশেষে সে বলে, “তারা এটাকে লিঙ্গম বলে থাকে, সুলতান। এটা দিয়ে পুরুষাঙ্গ বোঝানো হয় আর এটা উর্বরতার প্রতীক।” কিন্তু বাবরের দৃষ্টি ততোক্ষণে আঙ্গিনার অন্যপ্রান্তে একটা চাদোয়ার নিচে আসনপিড়ি অবস্থায় হাত উঁচু করে রেখে উপবিষ্ট এক শক্তিশালী লোকের প্রমাণ আকৃতির চেয়ে বড় মূর্তির দিকে আকৃষ্ট হয়েছে। তার অলঙ্কৃত মুকুটের নিচে কঠোর মুখের ভীষণদর্শন, স্থিরপ্রতিজ্ঞ চোখের দৃষ্টি সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
“এটা তাদের একটা দেবতা- তারা একে শিব বলে,” পুরোহিতের সাথে আরো একবার আলোচনা করে নিয়ে দোভাষী জানায়। কিন্তু দৃশ্যত পুরোহিতের আরো কিছু বলবার রয়েছে। কারণ সে তখনও বিড়বিড় করতে থাকে। জুনায়েদ বারলাস ঝুঁকে তার কথা শুনতে চেষ্টা করে। “পুরোহিত তাদের এক পবিত্র গ্রন্থে লিপিবদ্ধ কিছু শ্লোক আপনাকে বলতে চায়, সাবধান, আমি স্বয়ং প্রলয়। আমি শিব, ধ্বংসের বাহক…”
পুরোহিত আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্যাটা কি বলতে চায়? বাবর ধবংসকারী যে এখানে তাদের মাঝে এসে হাজির হয়েছে নাকি হিন্দু আর তাদের দেবতারা তাকে ধ্বংস করবে…?”
সে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভেতরের আঙ্গিনা থেকে প্রধান ভবনের ভিতর দিয়ে বাইরে বের হয়ে এসে মন্দিরের এলাকা ত্যাগ করে। সে ঘোড়ায় চেপে বসে তার পরিচারকের বাড়িয়ে ধরা পাত্র থেকে পানি পান করে ইশারায় জানায় পুনরায় যাত্রা শুরু করার জন্য সে প্রস্তুত। নিজের দেহরক্ষীদের পেছনে রেখে সে একবার পেছনের মন্দির বা তার রহস্যময় মূর্তির দিকে না তাকিয়ে সামনের দিকে রওয়ানা দেয়।
কয়েক গজ সামনে যাবার পরে তাদের ঠিক পথের উপরে একটা গরু মাটিতে থেবড়ে বসে রয়েছে দেখতে পায়। লম্বা পাপড়িযুক্ত চোখের চারপাশে ভনভন করতে থাকা মাছির দঙ্গলে তার খুব একটা অসুবিধা হয় না। লম্বা শিংযুক্ত একটা। প্রাণী এবং বাবরের মাতৃভূমির গরুর তুলনায় হাড্ডিসার, ফ্যাকাশে খয়েরী চামড়ার নিচে পাছা আর পাজরের হাড় পরিষ্কার গোনা যায়। বাবরের দেহরক্ষী দলের একজন সামনে এগিয়ে গিয়ে বর্শার হাতল দিয়ে তাকে একটা গুতো দেয়। গরুটা হাম্বা রবে প্রতিবাদ জানায় কিন্তু উঠে দাঁড়াবার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। লোকটা এবার বর্শাটা ঘুরিয়ে নেয় এবং তীক্ষ্ণ দিক দিয়ে খোঁচা দিতে চায় যাতে বেয়াদব গরুটা অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে, এমন সময় বাবরের পেছন থেকে কুদ্ধ চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে।
চারপাশে তাকিয়ে সে সেই বৃদ্ধ পুরোহিতকে তার হাড় জিরজিরে দেহের তুলনায় বিদ্যুৎ বেগে দৌড়ে আসতে দেখে। চিৎকার করার কারণে বুড়ো লোকটার মুখ বিকৃত হয়ে আছে। দৌড়াবার ফাঁকে লাঠি ধরা হাত তুলে প্রবল বেগে আন্দোলিত করছে। বাবরের দু’জন দেহরক্ষী লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ায় এবং বাবরের কাছাকাছি পৌঁছাবার আগেই তাকে আটকে দেয়।
বাবর জুনায়েদ বারলাসের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। “কি চায় সে?”
“সুলতান সে আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছে।”
“তার এই স্পর্ধার জন্য আমি চাবকে তার পিঠের চামড়া তুলে নেবো।”
“সুলতান আপনি বুঝতে পারেননি, সে বলতে চাইছে হিন্দুরা গরুকে পবিত্র প্রাণী হিসাবে বিবেচনা করে যা যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়াতে পারে। সে ভয় পেয়েছে যে আপনি বোধহয় গরুটাকে আঘাত করবেন…”
বাবর বুড়ো লোকটার দিকে তাকায়। “ওকে ছেড়ে দাও। আর তাকে বলল যে আমি বুঝতে পারিনি। তাকে আরো বলো যে তার ধর্মকে অসম্মান করার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই।”
জুনায়েদ বারলাসের ভাষান্তরিত কথা শুনে বৃদ্ধ লোকটার অভিব্যক্তি স্বাভাবিক হয়ে আসে। গরুটাও ততক্ষণে বিরক্ত হয়ে পড়েছে এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়িয়ে দূরে একটা গাছের ছায়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে। বাবরের সেনাবাহিনী তাদের সদ্য দখল করা ভূখণ্ডের উপর দিয়ে আবারও অবাধে এগিয়ে যেতে শুরু করে।
*
চারদিন পরে, বাবর আর তার বাহিনী দিল্লী পৌঁছালে সেখানের শাসনকর্তা কোনো প্রতিরোধ প্রদর্শন করে না। তার দেখা এটা সবচেয়ে জনবহুল আর বড় শহর। সমরকন্দ বা হিরাতের মতো আভিজাত্য নেই বটে শহরটার, কিন্তু কিছু কিছু অংশ দেখতে খারাপ না। সে বিশাল বেলেপাথরের তৈরি মসজিদ, সূক্ষ খিলানযুক্ত প্রাসাদ, এবং কৌতূহলকর খোদাইযুক্ত দুইশ চল্লিশ ফিট উঁচু উপরের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে যাওয়া স্তম্ভ- কুতুব মিনার পরিদর্শন করে। শতাব্দি পূর্বে কোনো অজানা কারণে নির্মিত হয়েছিলো। রাজকীয় সমাধিস্থল- গম্বুজযুক্ত, খিলানসংবলিত, স্ত যুক্ত- সব জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। এসব দেখে বাবর ভাবতে বাধ্য হয়- দিল্লীর সুলতানেরা যেমন জৌলুসপূর্ণ জীবনযাপন করেছিলেন, মৃত্যুর পরে তেমনি আড়ম্বরপূর্ণ সমাধিস্থলের ভক্ত ছিলেন। এখন মৃত্যু নগরীর কেবল বাসিন্দা হিসাবেই তারা স্মৃতিতে বেঁচে আছে…