বাবরের মনে সহস্র ভাবনা, অনুভূতি আর কল্পনার বেনোজলে প্লাবিত হয়ে উঠে। বাবুরীর কাটা কাটা চেহারা আর তীব্র নীল চোখ প্রথমবার দেখার সময় যখন সে বাবরের ধাবমান ঘোড়ার খুরে পিষ্ট হবার হাত থেকে একটা বাচ্চাছেলেকে বাঁচাতে লাফ দিয়েছিলো; বাবুরীর প্রথমবার ঘোড়ায় চড়ার চেষ্টা; তাদের যৌবনের প্রথম স্বাধীনতা; ফারগানার বেশ্যালয়ে তাদের বুনো মাতাল রাত কাটানো; বন্ধুত্ব আর সাহচর্যে কাটানো এতগুলো বছর। তাঁবুর ভেতরে শীতের বাতাসের তীব্রতার হাত থেকে বাঁচার জন্য পরস্পরকে জড়িয়ে থাকা, যুদ্ধ আর অভিযানের স্মৃতি যার কোনোটা সাফল্যমণ্ডিত আবার কোনোটা…
এসব ঘটনা এমন একটা প্রেক্ষাপটে ঘটেছে বাবুরী আর তার সেটা জন্মভূমি, শীতল, চঞ্চল, সর্পিল নদী, পরস্পরকে জড়িয়ে থাকা পাহাড়ের সারি, তীক্ষ্ণ-পার্শ্বদেশযুক্ত উপত্যকা এবং অবারিত সমভূমির দেশ। যেখানের বাতাস গ্রীষ্মকালে লবঙ্গের গন্ধ ভাসে আর শীতের সময়ে জমে ইস্পাতের মত শক্ত হয়ে থাকে। সবুজ আর ফিরোজা মিনার এবং গম্বুজে সমৃদ্ধ শহর। প্রাচীন মাদ্রাসা আর পাঠাগার যেখানে তৈমূরীয় রীতি সবাই বোঝে, আর শ্রদ্ধার চোখে দেখে। এখন বন্ধুহীন অবস্থায় বাবর এমন একটা নতুন জায়গায় উপস্থিত হয়েছে, যেখানে তাকে কেউ চেনে না। আর সেও এখানকার রীতিনীতি কিছুই বোঝে না। কেবল একটা বিষয়েই সে নিশ্চিত যে, এখানকার আবহাওয়া তার পছন্দ হয়নি। ঘামে মুখ সবসময়ে ভিজে থাকছে, আর ভারী বাতাসে শ্বাস নেয়াটাই একটা কষ্টসাধ্য প্রয়াস। তার পালকশোভিত পাগড়ীর নিচে মাথা দপদপ করে।
তারা এগিয়ে যাবার সময়ে অন্তত আর কোনো বিরূপতার মোকাবেলা করতে হয় না। মাঝে মাঝে বাবর তার অশ্বারোহী বাহিনী আর মালবাহী গাড়ির বিশাল বহর এগিয়ে চলার সময়ে দূরে ছোট ছোট দলকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। এখন চোখের উপরে হাত দিয়ে তারা যে চওড়া রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে তার একপাশে মাটির তৈরি বাড়িঘর দেখতে পায়। সূর্যের আলোয় গোবরের স্তূপ পড়ে আছে। লোমহীন, হাড্ডিসার কুকুরের দল সামান্য ছায়া খুঁজে নিয়ে বিশ্রাম করছে। এবং হাড্ডিসার মুরগীর দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়িগুলোতে বা আশেপাশের মাঠে কোনো লোকজন দেখা যায় না। সেখানে কেবল সরু পায়ের সাদা সারসের দলকে মহিষের পিঠ থেকে হলুদ ঠোঁট দিয়ে পোকামাকড় খুঁটে খেতে দেখা যায়।
আপাতদৃষ্টিতে একটা হতদরিদ্র গ্রাম। বাবর মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার ঠিক আগমুহূর্তে সে নিচু দেয়াল পরিবেষ্টিত অবস্থায় একটা বিশাল বেলেপাথরের অদ্ভুতদর্শন ভবন দেখতে পায়। গ্রামের তুলনায় ভবনটাকে বিসদৃশ্য দেখায়। সে কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখে মূল ভবনের সামনের প্রান্ত হাত, পা আর অবয়বের পরস্পর সংবদ্ধ খোদাই। করা একটা নিদর্শন চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। পানিপথের দীর্ঘ পথে বহুবার সে এধরণের ভবন দেখতে পেয়েছে। কিন্তু তখন তার সময় বা ইচ্ছা কোনো ছিলো না কাছে গিয়ে ভালো করে দেখবার।
সে ইশারায় থামতে বলে। সে তার কচিকে বলে, “দেখে এসো ওটা কি?”
পনের মিনিট পরে তার কর্চি এক ছোটখাট লোককে নিয়ে ফিরে আসে, যার মুখটা আখরোটের মতো কুঞ্চিত আর ভাঁজপড়া এবং চোখে বয়সের ছাপ। তাদের সাথে রয়েছে বাবরের এক সেনাপতি জুনায়েদ বারলাস। কাবুলে বসবাসকারী এক হিন্দুস্তানী কার্পেট ব্যবসায়ীর কাছ থেকে জুনায়েদ তরুণ বয়সে হিন্দুস্তানী ভাষা শিখেছিলো। ভালো কাউকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সে তাকেই তার দোভাষীর পদে নিয়োগ করেছে।
“সুলতান, এই লোকটা বলছে ওটা একটা হিন্দু মন্দির।” জুনায়েদ ব্যাখ্যা করে।
“আমার মনে হয় সে ঐ মন্দিরের একজন পুরোহিত।”
“আমি দেখতে চাই।” বাবর ঘোড়া থেকে নেমে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুরোহিতের দিকে তাকায়। লোকটার কোমরে কেবল একটা নেংটি পরা রয়েছে যা তার কোমরে একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা আর পুরো গায়ে কোনো কাপড়ের বালাই নেই। তার বাম কাঁধের উপর দিয়ে এসে ডান বাহুর নিচে দিয়ে একটা লম্বা সুতির সূতোর ফাঁস ঝুলছে। তার রুক্ষ্ম সাদা চুল আর দাড়ি লম্বা এবং জটপাকানো আর কপালে ছাইয়ের মতো কিছু একটা লেপটে রয়েছে। তার ডান হাতে একটা লাঠি ধরা আছে, তার মতোই গ্রন্থিযুক্ত।
পুরোহিত ধীর পায়ে তাকে ভেতর নিয়ে আসে। মূল ভবনটার মতো কিছু বাবর আগে কখনও দেখেনি। ভবনটার সামনের দিকটা সাত তলা বিশিষ্ট একটা কাঠামো, যার নিচের দিকটা ত্রিশ ফিট চওড়া আর উপরের দিকে উঠে সেটা একটা বর্গাকার চূড়ার আকৃতি নিয়েছে। খোদাই করা মানুষের নারী এবং পুরুষ- বিশালাকৃতি দেহ এবং বড় বড় চোখে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের পরনে আপাতদৃষ্টিতে দেহের সাথে আঁটসাঁট অর্ধস্বচ্ছ পোশাক, কপালে, গলায় আর বাহুতে অলঙ্কার পুরো দেয়াল জুড়ে খোদাই করা। এসবের মাঝে মাঝে অদ্ভুত, ভয়ঙ্করদর্শন, আর যুদ্ধবাজ চরিত্র যাদের কেউ কেউ মনে হয় নাচছে আবার কেউ রমণে লিপ্ত- মূর্তি খোদাই করা। কারো কারো পশুর মাথা- বানর এবং হাতির।
বাবর তাকিয়ে থাকে। জীবন আর প্রাণশক্তির উপাদানবাহী ইঙ্গিত। কিন্তু এসবের মানে কি? একটা দরজা দিয়ে তারা ভবনের ভিতরে প্রবেশ করে। একপাশে একসারি সংকীর্ণ সিঁড়ি ওপরের তলায় উঠে গিয়েছে। ভেতরে অপরিচিত তীব্র একটা গন্ধ, চন্দনকাঠের চেয়ে তীব্র ভারী আর মিষ্টি একটা গন্ধ। পুরোহিত কাঁধের উপর দিয়ে পেছন দিকে তাকায়। বাবরকে পেছনেই দেখতে পেয়ে পাথরের উপরে হাতের লাঠি ঠুকতে ঠুকতে সে সামনের দিকে আবার এগিয়ে যেতে শুরু করে। বাবর তাকে অনুসরণ করে ভেতরের বর্গাকার আঙ্গিনায় এসে দাঁড়ায়। যার চারপাশ দিয়ে বেষ্টনী দেয়া বারান্দা রয়েছে। দেয়ালগুলোকে হিন্দু কিংবদন্তী বা লোকগাথার দৃশ্য খোদাই করা রয়েছে। বানরের মতো দেখতে যোদ্ধার দল, হাতে ধরা খাটো তরবারি আন্দোলিত করে একটা সেতু অতিক্রম করে যুদ্ধের জন্য একটা দ্বীপে গমন করছে।