বাবর পাথরটার বিশুদ্ধতা আর উজ্জ্বলতা দেখে মুগ্ধ হয়। একটা নক্ষত্রের মতো পাথরটা থেকে আলো ঠিকরে আসছে। ঠিক যেনো ক্যানোপাস। বাবর ভাবে, নিজের ভাবনায় নিজেই হেসে ফেলে…তারপরেও পাথরটার তীব্র উজ্জ্বলতা দেখে একে বেহেশতের প্রস্তরখণ্ড বলে মনে হয়। পৃথিবীর মাটি খুঁড়ে এটা পাওয়া গেছে। বলে মনেই হয় না….
“বাছা, তুমি আসলেই তোমার সৌভাগ্যবান নামের সার্থকতা প্রমাণ করেছে। আশা করি আরো বহুদিন এই ধারা বজায় থাকবে-” বাবর তার কথার মাঝেই থেমে যায়। তাঁবুর উন্মুক্ত প্রবেশপথ দিয়ে সে দু’জন পরিচারককে সাদা কাপড়ে মোড়া একটা খাঁটিয়া তার তাঁবুর দিকে বয়ে নিয়ে আসতে দেখে। চারপাশ থেকে ভেসে আসা চিৎকার আর কোলাহলের শব্দে বোঝা যায় বাবুরীর বাহিনীও ফিরে এসেছে। কোথায় সে? বিজয়ের আনন্দ ভাগ করে নেয়ার জন্য সে নিজে কেন আসছে না? তারপরে তার চাদরের নিচে থেকে ধূলোতে লুটাতে থাকা হাতের সোনার ভারী কাজ করা রুবি বসানো আংটিটার দিকে তার দৃষ্টি আটকে যায়। বহুবছর আগে বাবুরিকে। সে এই আংটিটা দিয়েছিলো তাদের একটা অভিযানে জয়লাভের স্মারক হিসাবে। পরিচারক দুজন আলতো করে খাঁটিয়াটা মাটিতে নামিয়ে রাখার সময় বাবর তাদের বাবুরীর পরিচারক বলে চিনতে পারে।
বাবর যান্ত্রিক ভঙ্গিতে ঝুঁকে এসে কম্পিত হাতে রক্তে ভেজা চাদরটা সরিয়ে দিয়ে তার সহযোদ্ধা ভাইয়ের দলামোচড়ানো দেহটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
“আমরা সামনে পেছনে চল্লিশটা করে হাতির বহর নিয়ে দিল্লীর দিকে পলায়নপর ইবরাহিমের একটা বিশাল সুশৃঙ্খল বাহিনীর সম্মুখীন হয়েছিলোম। আমাদের প্রভু বাবুরী সাথে সাথে আক্রমণের আদেশ দেন। আর আমাদের দাপট সহ্য করতে না পেরে তারা যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। কিন্তু যুদ্ধের একেবারে শেষ মুহূর্তে মুখে আমূল প্রোথিত হয়ে ক্রুদ্ধ আর আহত একটা হাতি তাকে ঘোড়া থেকে ফেলে দিয়ে পিষে ফেলে।” পরিচারকদের একজন বলে।
বাবুরীর মুখটা কেবল প্রাণহীন আর ফ্যাকাশে হয়ে আছে- অক্ষত রয়েছে। তার তীব্র নীল চোখের পাতা ভোলা অবস্থায় তখনও বাবরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর ঠোঁটের কোণে একটা আলতো হাসি তখনও ফুটে আছে। বাবর নিজের কান্না চাপবার কোনো চেষ্টাই করে না, খাঁটিয়ার উপরে ঝুঁকে সে তার আধখোলা চোখের পাতা বন্ধ করে দেয় এবং কপালে আলতো করে চুমু খায়। “বিদায়, ভাই আমার…”
৪.৪ প্রথম মোঘল নৃপতি
২৩. প্রথম মোঘল নৃপতি
সূর্যের আলোর ধাতব দীপ্তি বাবরের চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। বৃষ্টিহীন শুষ্ক ভূপ্রকৃতির উপর দিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে যেখানে ঝোপঝাড়ের উপরে ধূলোর ভারী প্রলেপ পড়ে আছে। বাবর তার চারপাশে চার অশ্বারোহীর হাতে ধরা সোনালী দণ্ডের উপরে স্থাপিত হলুদ আর সবুজ জরির কাজ করা শামিয়ানার ছায়ার জন্য সে, কৃতজ্ঞ বোধ করে। একটা তীব্র বাতাস মাটি থেকে চাবকে ধূলো তুলে- সে ইতিমধ্যে জেনেছে তার নতুন প্রজারা একে আন্ধি বলে আর এর মানে বৃষ্টি হতে বেশি দেরি নেই।
পানিপথের যুদ্ধ সমাপ্ত হবার সাথে সাথে, বাবর হমায়ুন আর তার চার সেনাপতিকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র রেখে নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে দ্রুত গতিতে ইবরাহিমের আগ্রায় অবস্থিত রাজধানী অভিমুখে পাঠিয়ে দিয়েছে। শহরটা যমুনার তীরে দিল্লী থেকে একশ বিশ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। সেখানে অবস্থিত সেনাবাহিনী নিজেদের সংঘটিত করার আগেই দূর্গ আর রাজকোষ দখল করতে। এখন তিন দিন পরে, বাবর তার বিজয়ী বাহিনী নিয়ে দিল্লীর দক্ষিণে রওয়ানা দিয়েছে। সবশেষে, ধূলোর মেঘের আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে আছে। রয়েছে রণহস্তীর দল- এখনও লাল রঙে রঞ্জিত- তার লোকজন যুদ্ধ শেষে প্রাণীগুলোকে আটক করেছে।
বাবরের যুদ্ধ জয়ের আনন্দ বাবুরীর মৃত্যুতে অনেকটাই মলিন হয়ে গিয়েছে। তার। মৃত্যু সংবাদ শোনার সাথে সাথে সে নিজের তাঁবুতে ফিরে গিয়ে একাকী বসেছিলো। হিন্দুস্তানের নতুন সম্রাট হিসাবে কারো সাথে দেখা করতে বা কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে সে অপারগতা প্রকাশ করে। বাবুরীর মৃত্যুতে সে কেবল একজন ভালো বন্ধুকেই হারায়নি- তার মনে হচ্ছে একটা যাপিত জীবনের যেনো সমাপ্তি ঘটেছে। সে আর কখনও কখনও তার মতো বন্ধু পাবে না যে তার যৌবনের সহচর, আর ভাগ্য বিড়ম্বনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং অংশীদার ছিলো।
বাবুরীর সাথে যখন তার প্রথম দেখা হয় তখন তার নিজের বয়স বিশ বছরও হয়নি। ফারগানার একটা ছোট অংশের শাসক, সুলতানের চেয়ে যার সাথে যুদ্ধবাজ সর্দারের মিল বেশি। এখন সে সন্তানের পিতা আর এক বিশাল সাম্রাজ্যের সম্রাট। যাকে সবসময়ে নিজের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং অন্যদের সাথে তার সামাজিক মর্যাদা যাই হোক সবসময়ে একটা দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এখন। থেকে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হবে তার সন্তানেরা। সে তাদের খুবই ভালোবাসে, কিন্তু বাবুরীর মতো সম্পর্ক তাদের সাথে হবে না। তাদের ভিতরে বয়স আর অভিজ্ঞতার পার্থক্য। তার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা আর সন্তানোচিত আনুগত্য। আর সেই সাথে তাদের আগলে রাখার জন্য তার অনবদ্য প্রয়াস এবং কিভাবে জীবনযাপন আর শাসন করতে হবে সেসব তাদের শিক্ষাদানের প্রয়াস এসবই তাদের সম্পর্কের ভিতরে অমোঘভাবে অবস্থান করবে। তারা কখনও তার বিরোধিতা করতে বা তাকে তাচ্ছিল্য করার তার সাথে রসিকতা করার সাহস পাবে না- যা বাবুরী প্রায়ই করতো…