“এবং অবশেষে ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে, আমাদের পূর্বপুরুষ মহান তৈমূর যোদ্ধা তৈমূর, যার নামের মানে ‘লোহা’ আর পৃথিবীর উপর দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে দাবড়ে যাবার সময়ে তার অশ্বপালের গা থেকে ঘামের মত রক্ত ঝরতো- একটা বিশাল সাম্রাজ্য জয় করেন। যুবক বয়সে যদিও মারাত্মকভাবে জখম হবার কারণে তার এক পা অন্য পায়ের চেয়ে লম্বা হয়ে গিয়েছিল এবং হাঁটবার সময়ে তিনি সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। তিনি তারপরেও দিল্লী থেকে ভূমধ্যসাগর, সমৃদ্ধ পার্সিয়া থেকে ভলগার অরণ্যভূমি পর্যন্ত একটা বিশাল এলাকা জয় করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেটা কি তৈমূরের জন্য যথেষ্ট ছিলো? প্রশ্নই ওঠে না! তার শরীর তখনও। শক্তিশালী আর প্রাণবন্ত, পাথরের মত শক্ত তার দেহ আর অফুরন্ত তার আকাঙ্ক্ষা, জীবনের আরো অনেকগুলো বছর তার তখনও উপভোগ করা বাকী। নব্বই বছর আগে চীনের বিরুদ্ধে অভিযানই ছিলো তার শেষ অভিযান। দু’লক্ষ অশ্বারোহী বাহিনীর নির্ভরতার বরাভয়ে তিনি অভিযানে বেরিয়েছিলেন এবং অবশ্যই বিজয় তার পদচুম্বন করতো, যদি আল্লাহতালা তাকে বেহেশতে নিজের সান্নিধ্যে ডেকে না। নিতেন। কিন্তু তৈমূর, মহান যোদ্ধাদের ভিতরে মহানতম- এমন কি তোমার আরেক পূর্বপুরুষ চেঙ্গিস খানের চেয়েও মহান- কিভাবে এসব সম্ভব করেছিলেন? বাছা, তোমার চোখে আমি এই প্রশ্নটাই ভাসতে দেখছি, এবং তোমার অধিকার আছে সেটা জিজ্ঞেস করবার।”
পরম মমতায়, সুলতান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, তার দিকে বাবরের টানটান মনোযোগ খেয়াল করেন। তারপরে তিনি আবার বলতে শুরু করেন, কুশীলবের পারঙ্গমতায় তার কণ্ঠস্বরে তখন আবেগ খেলা করতে থাকে।
“তৈমূর ছিলেন সাহসী আর ধূর্ত কিন্তু তার বড় পরিচয় তিনি ছিলেন একজন জাত নেতা। আমার দাদা আমাকে বলেছিলো তার চোখ ছিলো মোমবাতির আলোর মত দূতিহীন, নিষ্প্রভ। মানুষেরা স্তব্ধ আলোর সেই ফাটলের দিকে একবার তাকালে আর চোখ ফিরিয়ে নিতে পারতো না। এবং তৈমূর তাদের আত্মার দিকে তাকিয়ে সেই গৌরবের কথা শোনাতেন শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে যার প্রতিধ্বনি শোনা যাবে এবং পৃথিবীর বুকে তাদের থেকে যাওয়া দেহাস্থির প্রাণহীন ধূলোয় ঘূর্ণি তুলবে। চকচকে সোনা আর দূতিময় রত্নের কথা তিনি শোনাতেন। তার রাজধানী সমরকন্দের দাসবাজারে রেশমের মত কালো চুলের যেসব নিটোল গড়নের মেয়েদের তারা দেখেছে, তিনি তাদের কথা বলতেন। এসব ছাড়াও তিনি তাদের জন্মগত অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। পৃথিবীর অধিশ্বর হবার বকেয়া অধিকারের কথা তাদের মনে করিয়ে দিতেন। তাদের চারপাশে তৈমূরের মন্দ্র কণ্ঠস্বর বয়ে গিয়ে, তাদের মানসপটে সেইসব দৃশ্যের অবতারণা করতো, যা কেবল তাদের পদানত হবার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে আর শীঘ্রই তারা নরকের জ্বলন্ত তোরণের নিচে তার অনুগামী হতো।
“বাছা, তাই বলে তাকে বর্বর ভেবো না।” সুলতান প্রচণ্ড ভঙ্গিতে মাথা নাড়লে তার লালচে-খয়েরী রঙের সিল্কের পাগড়ীর সঞ্জাব এপাশ ওপাশ দুলতে থাকে। “না। তিনি ছিলেন একজন সংস্কৃতিবান মানুষ। তার প্রিয় সমরকন্দ ছিলো রুচি আর সৌন্দর্য, জ্ঞান আর পৃষ্ঠপোষকতার শহর। কিন্তু তৈমূর একটা কথা খুব ভালো করে জানতেন যে, একজন বিজয়ীর সামনে কোনো কিছুই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। অভিযান সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্মমতা তার মনপ্রাণ অধিকার করে রাখতে এবং যতবেশি মানুষ সেটার পরিচয় পেতো ততোই মঙ্গল।” তিনি নিজের চোখ বন্ধ করেন এবং পূর্বপুরুষের বিস্ময়কর গৌরবময় দিনগুলো যেনো মানসপটে দেখতে পান। গর্ব আর উত্তেজনার এমন তীব্র একটা রেশ তাকে জারিত কমে যে, তার কপালে স্বেদবিন্দু দেখা দেয়। একটা হলুদ রুমাল বের করে তিনি কপালের ঘাম মোছেন।
বাবর তার বাবার বাচনশৈলীতে সৃষ্ট দৃশ্যকল্পে বরাবরের মতই উল্লসিত হয়ে উঠে। তার দিকে তাকিয়ে হাসে, দেখাতে চায় একই হর্ষোৎফুল্ল গর্বের সেও সমান অংশীদার। কিন্তু সে তাকিয়ে থাকা সত্ত্বেও তার বাবার মুখের অভিব্যক্তি বদলে যায়। তার গভীর চোখে জন্ম নেয়া ঐকান্তিক আলো ম্লান হয়ে আসে এবং সেখানে হতাশার জন্ম হয়। সেখান থেকে আসে বিষণ্ণতা। বাবরের হাসি আড়ষ্ঠ হয়ে উঠে। তার বাবার গল্প সচরাচর তৈমূরের বন্দনার ভিতর দিয়ে শেষ হয়, কিন্তু আজ যেন সুলতানকে কথায় পেয়ে বসেছে। তিনি কথা চালিয়ে যান তার কণ্ঠের উদ্দীপনা মিলিয়ে গিয়ে সেখানে বিষণ্ণ নিরানন্দভাব ফুটে উঠে।
“কিন্তু আমি যদিও আমি মহান তৈমূরের উত্তরপুরুষ-আমার কি আছে? কেবল ফারগানা। এমন একটা রাজ্য যা টেনেটুনে দুইশ মাইল লম্বা বা একশ মাইল চওড়া। চারদিকে তাকিয়ে দেখো- তিনদিকে পাহাড়বেষ্টিত একটা উপত্যকা, যেখানে কেবল ভেড়া আর ছাগলের গলার ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যায়।” মেঘাবৃত বেস্তর পর্বতের সুউচ্চ চূড়ার দিকে তিনি হাত তোলেন। “অথচ পশ্চিমে তিনশ মাইল দূরে আমার ভাইয়েরা স্বর্ণমণ্ডিত সমরকন্দের শাসক। আর দক্ষিণে হিন্দুকুশের ওপারে আমার অন্য ভাইয়েরা সমৃদ্ধ কাবুল কজা করে রেখেছে। গরীব আত্মীয় হিসাবে আমি তাদের অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যের পাত্র। যদিও আমার ধমনীতে- তোমার ধমনীতেও তাদের মত একই রক্ত প্রবাহিত।”