বিজয় এত দ্রুত অর্জিত হয়েছে যে তখনও দুপুরই হয়নি। বাবর যখন নিজের ঘোড়ার মুখ শিবিরের উদ্দেশ্যে ঘুরিয়ে নেয় এবং অতিকায় পাথরের টুকরোর মতো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পড়ে থাকা হাতির পাল আর তাদের পিঠের উপরের হাওদার ধবংসাবশেষ আর তাদের পতনের ফলে পিষ্ট হয়ে যাওয়া সৈন্যদের মৃতদেহের একটা দঙ্গলের ভিতর দিয়ে সে শিবিরে ফিরে চলে। গরমের মাঝে, তার লোকেরা ইতিমধ্যে নিজেদের আহত যযাদ্ধাদের কোনোমতে তৈরি করা খাঁটিয়ায় শুইয়ে দিতে শুরু করেছে এবং পানি দিয়ে বা অন্য যেভাবে পারে তাদের শুশ্রূষা করার চেষ্টা করছে।
নিজের লাল তাঁবুর ভিতরে আরো একবার বাবর অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করতে থাকে। বাবুরী আর হুমায়ূনের কি খবর? সে নিজের পোড়খাওয়া বন্ধুর চেয়ে তার অনভিজ্ঞ ছেলের জন্যই বেশি উদ্বিগ্ন বোধ করে। হুমায়ূনের যদিও এর আগে খণ্ড যুদ্ধে লড়াই করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, কিন্তু এবারই সে একটা বড় যুদ্ধে নিজে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করছে এবং প্রতিরক্ষা ব্যুহের ডানপাশের সৈন্যদের নেতৃত্ব দেয়াটা তার জন্য একটা বিশাল আর অনুপম দায়িত্ববোধ।
বাবর দুশ্চিন্তা ভুলে থাকবার জন্য আহতদের দেখতে যায় এবং বিশেষ সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছে এমন যোদ্ধাদের পুরস্কৃত করে এবং একই সাথে ইবরাহিমের শিবির থেকে জব্দ করা মালামালের বিবরণ শোনে। এখনই মনে হচ্ছে স্বর্ণমুদ্রা আর মূল্যবান পাথরের একটা বিশাল সংগ্রহ তার কুক্ষিগত হয়েছে।
আরো ছয় ঘণ্টা উৎকণ্ঠায় কাটার পরে একজন প্রহরী ভিতরে প্রবেশ করে ঘোষণা করে, “ শাহজাদা হুমায়ূনের নিশান আর ঝাণ্ডা বহনকারী সৈন্যবাহিনী শিবিরের দিকে এগিয়ে আসছে।”
প্রহরীর কথা শেষ হবার আগেই পরিশ্রান্ত হুমায়ুন তাবুতে প্রবেশ করে, তার পিতার দিকে দৌড়ে গিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে। “আমাদের বিজয় সম্পূর্ণ হয়েছে। আমরা এখন হিন্দুস্তানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আমরা দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় দশ মাইল ইবরাহিমের একটা বিশাল বাহিনীকে ধাওয়া করতে অবশেষে তারা নদীর তীরে একটা মাটির দূর্গে অবস্থান নিয়ে আমাদের মুখোমুখি হয়। এক ঘণ্টার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরে আমরা তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করি। আরো খানিকটা পশ্চিমে আমরা অভিজাতদের একটা দলের একসারি তাবু আবিষ্কার করি। মুষ্টিমেয় সংখ্যক প্রহরী বা পরিচারকের দল এর পাহারায় নিয়োজিত ছিলো। দেখতে ডাকাত বা লুটেরাদের মতো দেখতে কোনোভাবেই তাদের সৈন্যবাহিনীর সদস্য বলা যাবে না। এমন একদল ঠ্যাঙাড়ের মোকাবেলা করছে।
“আক্রমণকারীদের আমরা হত্যা করলে তাঁবুর ভিতর থেকে আমার আম্মিজানের বয়সী একজন মহিলাকে দুধসাদা রঙের আর ঘিয়ে এবং সোনালী কাপড়ের শামিয়ানা টাঙানো একটা তাঁবুর ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে দেখি। তার পরনে হিন্দুস্তানীরা যাকে শাড়ি বলে তেমন একটা পরিধেয়। সেটা উত্তম রেশমের তৈরি আর অসংখ্য মুক্তা আর অন্যান্য দামী পাথর তাতে সেলাই করে লাগানো রয়েছে। তিনি জানতে চান কে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং আমার নাম আর পরিচয় জানতে পেরে তিনি আমার কাছে তাকে নিয়ে যেতে বলেন। আমার কাছে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন যে তিনি গোয়ালিয়রের, দিল্লীর দক্ষিণে অবস্থিত একটা সমৃদ্ধ রাজ্য, শাসকের মাতা। তিনি জানতে পেরেছেন ইবরাহিমের পক্ষে বীরের মতো লড়াই করে তার পুত্র মারা গিয়েছে।
“খবরটা শোনার পরে তিনি পালিয়ে না গিয়ে ছেলের অন্তেষ্টিক্রিয়া সুসম্পন্ন করার জন্য তার মৃতদেহ গ্রহণ করবেন বলে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। তারা পৌত্তলিক, যারা বেদীর উপরে মৃতদেহ রেখে আগুনে পুড়িয়ে থাকে। তারপরে এক পলায়নপর সৈন্য তাদের শিবিরের পাশ দিয়ে পালিয়ে যাবার সময় বলে যায় যে আমাদের সৈন্যরা বন্দিদের হত্যা করছে। তখন মুষ্টিমেয় সাহসী কয়েকজন সৈন্য ছাড়া বাকিরা তাকে সেখানে ফেলে পালিয়ে যায়। এবং দস্যুর দল- তার ভাষায় ডাকাত- যাদের আমরা পরাজিত করেছি সুযোগ টের পেয়ে তার শিবির আক্রমণ করে। তিনি নিজের জীবন আর সম্ভ্রমের চেয়েও তার ছয় মাসের নাতি, আর তার তরুণী মাতা, মৃত শাসকের প্রিয়তমা স্ত্রী, যে তার সাথেই শিবিরে অবস্থান করছিলো, তাদের নিরাপত্তার জন্য বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েন।
“আমি তাকে ভয় পেতে মানা করি। বলি যে আমরা সুসভ্য, সংস্কৃতিবান মানুষ, এই ডাকাতদের মতো বর্বর নই। কৃতজ্ঞতার অশ্রুবিন্দুতে তার মুখ সিক্ত হয়ে উঠে এবং তিনি আমাকে এটা দেন যা আমি আপনাকে আমাদের মহান বিজয়ের স্মারক হিসাবে এখন আপনাকে দিচ্ছি।” কথার মাঝেই হুমায়ূন বাবরের দিকে লাল চামড়ার একটা থলি এগিয়ে দেয় যেটার মুখ সোনালী জরির কাজ করা চামড়ার দিয়ে বাঁধা। বাবর মুখের বাঁধনটা খুলে এবং ভেতর থেকে একটা বেশ বড় পাথর বের করে আনে, পাথরটা তাঁবুর আধো-অন্ধকারের ভিতরে অপরূপ বিভায় ঝলসে উঠে। “আব্বাজান এটা একটা হীরক খণ্ড এখান থেকে হাজার মাইল দক্ষিণে গোলকুণ্ডার খনিতে কেবল এই পাথর পাওয়া যায়। আমি এতো বড় হীরকখণ্ড আগে দেখিনি। গোয়ালিয়রের রাজপরিবারের রত্নাকর একবার এর মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছিলো যে পুরো পৃথিবীর অর্ধদিনের ব্যয় নির্বাহ করা যাবে এটা দিয়ে। একে তারা বলে কোহ-ই-নূর, আলোর পর্বত…”