শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাবর অনড় দাঁড়িয়ে থাকে তারপরে লাফিয়ে একপাশে সরে যায় এবং একই সাথে তীব্র বেগে আলমগীর দিয়ে কোপ বসানোর ভঙ্গিতে আঘাত করে। সাদা ঘোড়ার গলার বাম পাশে তার তরবারি আড়াআড়িভাবে আঘাত করে এবং তারপরে তার আরোহীর উরুতে গভীর একটা ক্ষত তৈরি করে। বোঝাই যায় লোকটা আদতেই দক্ষ ঘোড়সওয়ার এবং আঘাতের ভয়াবহতা সত্ত্বেও সে জিনের উপরে অধিষ্ঠিত থাকে। ঘোড়াটাকে নিয়ন্ত্রণ করে মুখ ঘুরিয়ে নেয়- সাদা চামড়া এখন লাল রক্তে ভিজে উঠেছে- বাবরকে আরো একবার আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসে।
এই দফা, শত্রু সেনাপতি তাকে কবন্ধ করার অভিপ্রায়ে তরবারি চালাতে সে নিচু হয়ে আঘাতটা এড়িয়ে যায় এবং আলমগীর দিয়ে ধাবমান ঘোড়ার সামনের পায়ের শিরা কেটে দিতে চেষ্টা করে। সে তার নিশানা ভেদ করতে সমর্থ হয় এবং ঘোড়াটা তার আরোহীর উপরে আছড়ে পড়লে বেচারার মুঠি থেকে তরবারিটা ছুটে যায়। লোকটা তার তরবারির কাছে পৌঁছাবার জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকলে বাবর এগিয়ে এসে তার কব্জিতে পা রেখে আলমগীরের ডগা তার গলায় স্পর্শ করে। “আত্মসমর্পণ করো। তোমার সাহসিকতার জন্যই তুমি বেঁচে থাকার দাবিদার।” সে তার সাথে কথা বলার সময়ে বাবরের আরো লোক এসে তার পাশে দাঁড়ায়। সোনালী পাগড়ি পরিহিত যোদ্ধাদের অধিকাংশই হয় তাদের হাতে মারা পড়েছে। কিংবা পালিয়েছে। প্রতিরোধের চেষ্টা করা বৃথা বুঝতে পেরে, লোকটা চুপচাপ শুয়ে থাকে। “আমি কথা দিচ্ছি আমার তরফ থেকে আর যুদ্ধের কোনো প্রয়াস নেয়া হবে না।” সে বলে।
“তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করো… তুমি আর তোমার লোকেরা এতো মরিয়া হয়ে কি রক্ষা করতে চেষ্টা করছিলে?”
“সুলতাম ইবরাহিম লোদির মৃতদেহ। টিলার মাথায় রাখা আছে। আপনার নতুন অস্ত্রের ছোবলে তিনি শুরুতেই মারাত্মকভাবে আহত হন। সাহসিকতার কোনো মূল্যই নেই এর সামনে।”
“কোনো অস্ত্রই সেটা যে নিশানা করছে তার চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর হতে পারে না।” তারা যখন কথা বলছে সেনাপতির সাদা ঘোড়াটা তখন যন্ত্রণায় ঝটফট করতে থাকে আর আর্তনাদ করে। গলার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়ছে। সামনের পায়ে বাবরের আঘাতের ফলে সেখানকার শিরা কেটে যেতে বেচারা সামনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতেও পারছে না। এখন মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকলে এবং কথা বলটা ক্রমশ কষ্টকর হয়ে উঠতে- সম্ভবত নিজের ঘোড়ার নিচে চাপা পড়ার ফল সেনাপতি কোনোমতে বলে, “আমাকে আমার ঘোড়াটার যন্ত্রণা লাঘব করার অনুমতি দিন। আমার সাথে অনেক যুদ্ধে সে অংশ নিয়েছে। অনেক শান্তভাবে সে মৃত্যুকে বরণ করবে যদি সেটা আমার কাছ থেকে আসে।”
বাবর তার লোকদের একজনকে সেনাপতির তরবারি ফিরিয়ে দিতে বলে। সেনাপতি- উরুর ক্ষতের কারণে হাঁটতে তার নিজেরই কষ্ট হয় আর শ্বাস নিতে অপারগতার মাঝে- ঘোড়াটার কাছে এগিয়ে যায়। সোনার কারুকাজ করা চামড়ার লাগাম ধরে সে ঘোড়াটার নাকে আলতো করে চাপড় দেয়। মাথাটা আঁকড়ে ধরে এবং কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে সান্ত্বনা দেয়। তারপরে দ্রুত তরবারিটা গলার উপরে আড়াআড়িভাবে রেখে সে এক পোচে শ্বাসনালী আর ধমনী কেটে দিলে গলগল করে আরও রক্ত বের হয়ে আসে। ঘোড়াটা সাথে সাথে নেতিয়ে পড়ে এবং কিছুক্ষণের ভিতরেই নিথর হয়ে যায়। গলার কাটা জায়গা থেকে রক্ত বের হয়ে এসে ধূলোয় জমতে থাকে। অবশ্য সেনাপতির কাজ তখনও শেষ হয়নি। সে তার হাতের তরবারি দিয়ে এবার নিজের পেট চিরে দেয়। “আমার ঘোড়ার চেয়ে পঙ্গু অবস্থায় আমি বেঁচে থাকতে চাই না।”
“আল্লাহতালা তোমার বেহেশত নসীব করুন।”
“আমিও সেই দোয়াই করছি। কিন্তু মনে রাখবে হিন্দুস্তানকে পদানত করতে হলে তোমাকে আমার চেয়ে অনেক বেশি সাহসী লোকদের পরাভূত করতে হবে।”
তার গলায় রক্তের বুদবুদের মাঝে শেষ কথাগুলো অস্পষ্ট শোনা যায়। সেও মারা যায়। তার দেহটা বহুদিনের সঙ্গী ঘোড়াটার পাশে এলিয়ে পড়ে থাকে এবং সোনালী পাগড়ি পরিহিত মাথাটা রক্ত রঞ্জিত মাটিতে নুইয়ে আসে।
“সুলতান, যুদ্ধে আপনার জয় হয়েছে।”
নিশানবাহক কর্চির কথাগুলো বাবরকে তার সামনের দৃশ্যাবলীর সম্পর্কে গভীর ভাবনা থেকে বাস্তবে নিয়ে আসে। চারপাশে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে, যুদ্ধক্ষেত্র নিরব হয়ে এসেছে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে…সে বিজয়ী হয়েছে। “সব প্রশংসা আল্লাহ’র।” একটা স্বস্তির পরশ ঝড়ের মতো এসে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তারপরে নিজের জয়লাভের মাহাত্ব বুঝতে পেরে সে খুশিতে শূন্যে ঘুষি চালাবার ভঙ্গিতে হাত নাড়ায়। সে- তৈমূরের মতো- দিল্লীতে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করতে পারবে…
নিজের মনকে আবার সে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। বাবর তার চারপাশের অশ্বারোহীদের উদ্দেশ্যে নিজের প্রথম অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। “আমরা দারুণ একটা কাজ করেছি। এখন আশা করি হুমায়ুন আর বাবুরীও ইবরাহিমের পলায়নপর সৈন্যদের আমূল বিনাশসাধন করে বা তাদের বন্দি করতে সক্ষম হবে। তাদের সুলতান মৃত হবার কারণে তারা সহসাই অন্য কারো নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে পারবে না। ইবরাহিম আর- এই সাহসী যোদ্ধাটাকে- যথাযথ মর্যাদায় সমাহিত করবে। আমি এবার শিবিরে ফিরে গিয়ে পিছু ধাওয়া করার ফলাফল জানবার জন্য অপেক্ষা করবো।”