সে এবার সামনের দিকে তাকিয়ে ইবরাহিমের সৈন্যবাহিনীকে দ্রুত এগিয়ে আসতে দেখে। সে যেমনটা আশা করেছিলো, রণহস্তির দলকে সামনে নেতৃত্ব দিতে দেখে। বেশিরভাগই মনে হয় দুই মানুষ পরিমাণ উঁচু আর তাদের একপাশে প্রসারিত হয়ে অংশত আবৃত ইস্পাতের বর্ম সূর্যের আলোয় ঝকঝক করতে থাকে। বাঁকান তরবারির সারি- প্রতিটা ছয় ফিট লম্বা- লাল রঙ করা শুড়ের সাথে বাঁধা। তাদের পরিচালনাকারীরা হাতে ধরা লম্বা কাঠের লাঠিতে ফুঁ দিয়ে হাতিগুলোকে আরও দ্রুত অগ্রসর হবার তাগিদ দেয়। হাওদায় হাতির পিঠে স্থাপিত অনেকটা দূর্গের মতো দেখতে একটা স্থাপনা অবস্থানরত তীরন্দাজের দল ইতিমধ্যে তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করেছে। কিন্তু তীরগুলো লক্ষ্যবস্তু থেকে অনেক দূরে ভূপাতিত হয়। তারা এখনও পাল্লার বাইরে অবস্থান করছে।
বাবর আশা করে তার লোকেরা তার আদেশ মান্য করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারার মতো দূরত্ব সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তীর নিক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু তার আগে ইবরাহিমের লোকেরা আর পশুর পাল বাবরের পশ্চিম থেকে নিয়ে আসা নতুন অস্ত্রের প্রতিক্রিয়া অনুভব করবে: কামান। বাবর আলমগীর মাথার উপরে তুলে দু’বার আন্দোলিত করে- আলী কুলী আর তার লোকদের গোলা বর্ষণ শুরু করার জন্য এটা একটা পূর্বনির্ধারিত সংকেত। সে স্পর্শ-রন্ধের বারুদে গোলন্দাজ সেনাদের একজনকে ঝুঁকে জ্বলন্ত শলাকা স্পর্শ করাতে দেখে। তারপরে একটা ঝলক, একটা গর্জন এবং কামানের নল থেকে সাদা আলো বের হয়ে এসে কামানের গোলাটা শক্ত অবস্থানের দিকে ছুঁড়ে দেয়। বাকী কামানগুলো থেকে ক্রমান্বয়ে আলোর ঝলক দেখা যায় এবং মাটির তৈরি পুরো প্রতিবন্ধকতা মাঝ দিয়ে ধোয়ার একটা মেঘ ভাসতে থাকে।
বাবর ধোয়ার মেঘের মাঝ দিয়ে সামনের সারির একটা হাতিকে হাওদাসহ মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখে এবং এর আরোহীরা মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে আছড়ে পড়ে। তারপরে আহত প্রাণীটা টলোমলো করতে করতে আবার সটান উঠে ঘুরে দাঁড়ায়, শুড়টা ব্যাথার তূরীর মতো শূন্যে তুলে ধরে এবং পাশের হাতির দিকে উন্মত্তের মতো ছুটে গিয়ে তাকে নিয়ে পুনরায় মাটিতে আছড়ে পড়ে। সামনের আহত পা থেকে গলগল করে রক্ত বের হয়ে আসছে। মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় বিশাল মাথাটা যন্ত্রণায় আছড়াতে থাকলে এর শুড়ের সাথে আটকানো তরবারি। পেছন থেকে এগিয়ে আসা আরেকটা হাতিকে আঘাত করলে ভয়ে আর ব্যাথায় সেটা দ্বিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াতে শুরু করে। কিন্তু যদিও আগুয়ান সারির প্রস্থ বরাবর এমন ঘটনা ঘটতে থাকে কিন্তু সুলতান ইবরাহিমের সেনাবাহিনী সামনের দিকে চাপ প্রয়োগ করা অব্যাহত রাখে।
বাবর সহসা মাস্কেটের গুলিবর্ষণের মড়মড় আওয়াজ শুনতে পায়। তার আরও শত্রু ভূমিশয্যা নেয়। এবার তার তীরন্দাজের দল তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করে। কেউ কেউ মাটির দেয়ালের আড়াল ছেড়ে লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি এগিয়ে যায়- হাতির সাদা রঙ করা কানের পেছনে বসে থাকা চালকগুলো তাদের নিশানা। ইবরাহিমের সামনের সারি এবার এলোমেলো হয়ে পড়ে। ভয়ে আরও অনেক হাতি শুড় তুলে নিয়ে পেছনের দিকে ঘুরে দৌড়াতে শুরু করে এবং পেছনে থাকা লোকগুলোর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাদের থামিয়ে দিয়ে আরও আতঙ্কের সৃষ্টি করে এবং তারা পালাতে থাকলে তাদের বিশাল পায়ের চাপে নিজেদের লোকেরাই অসহায়ের মতো পিষে যেতে থাকে।
বাবর আরও অশ্বারোহী তীরন্দাজদের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসে দ্রুত পলায়নপর শত্রুদের লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করার আদেশ দেয়। সে যখন এই আদেশ দিচ্ছে। তখন তার খুব কাছেই সে একটা বিকট বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পায় এবং তার চারপাশে ধাতুর উত্তপ্ত টুকরো এসে আছড়ে পড়ে আর তার মুখে নরম কিছু একটা আঘাত করে। বিভ্রান্ত আর আংশিক বধির অবস্থায়, সে বুঝতে পারে না ঠিক কি ঘটেছে। তারপরে সে টের পায় তার একটা কামান বিস্ফোরিত হয়েছে এবং আলী কুলী ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে। সে গালে হাত দিয়ে টের পায় সেটা ওস্তাদ গোলন্দাজের মাংসের টুকরো। পৃথিবীতে না, আলী কুলী বেহেশতে তার প্রাপ্য গ্রহণ করবে। কিন্তু সে তার কাজ ভালোমতোই সম্পন্ন করে গিয়েছে। মওকা বুঝে সুলতান ইবরাহিমের সৈন্যরা আরো আরো বেশি সংখ্যায় পালাতে শুরু করেছে। যাদের ভেতরে খালি পায়ের কোমরে কেবল একটা নেংটি পরিহিত পদাতিকদের সংখ্যাই বেশি। বর্শা ছাড়া আক্রমণের বা আত্মরক্ষার কোনো অবলম্বন তাদের নেই।
নিজেকে সুস্থির করে নিয়ে, বাবর তার সেরা অশ্বারোহীদের এবার অগ্রসর হবার ইঙ্গিত করে এবং নিজের কালো ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে ধূলো আর ধোঁয়ার মেঘের মাঝে তাদের নেতৃত্ব দিয়ে আধ মাইল দূরে আতঙ্কিত পলায়নপর লোকদের কোলাহলপূর্ণ জটলার দিকে ধেয়ে যায়।
ইবরাহিমের বাহিনীর কিছু অংশ অনেক বেশি প্রশিক্ষিত আর তারা নিজেদের রক্ষণাত্মক অবস্থানে সন্নিবেশিত করে সত্যিকারের বীরের মতো আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। বাবর একটা টিলার উপরে এমনই একটা অশ্বারোহী দলকে সংখ্যায় শতাধিক হবে। সবার মাথায় সোনালী পাগড়ি- সাফল্যের সাথে সব আক্রমণ প্রতিহত করতে দেখে।
“ইবরাহিমের দেহরক্ষী বাহিনী। তার এক সৈন্য চিৎকার করে বলে। বাবর এবার সরাসরি তাদের মাঝে লম্বা এক যোদ্ধার দিকে এগিয়ে যায়। যাকে এই ক্ষুদে দলটার নেতৃত্ব দানকারী সেনাপতি বলে প্রতিয়মান হয়। শেষমুহূর্তে বাম পাশে সরে গিয়ে বাবর তাকে পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে দিয়ে, তার ডান হাত লক্ষ্য করে তরবারি চালায়। কিন্তু সোনালী পাগড়ি পরিহিত সেনাপতি সময়মতো ঢাল তুলে তার আঘাত প্রতিহত করে এবং অন্য হাতে ধরা তরবারি দিয়ে বাবরের কালো ঘোড়ার পাছায় একটা মোক্ষম কোপ বসিয়ে দেয়। ঘোড়াটা যন্ত্রণায় পিছনে সরে আসে এবং বাবরকে মাটিতে আছড়ে ফেলে। সে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করার ফাঁকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে পায় শত্রু সেনাপতি নিজের সাদা ঘোড়াটাকে এগিয়ে যেতে ইশারা করে সামনে ঝুঁকে রয়েছে বাবরকে শেষ করে দেবার অভিপ্রায়ে।