“ভালোমতো ঘুমিয়ে নাও। আমি নিশ্চিত, ভালোমতো বিশ্রাম নিলে ভাগ্য তাকে সহায়তা করে।”
বাবুরী কোনো উত্তর না দিয়ে তাঁবু থেকে বের হয়ে যায় এবং বাইরের অন্ধকারের ভিতরে হারিয়ে যায়।
*
ভোর হবার সাথে সাথে সুলতান ইবরাহিমের শিবিরে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়- চিৎকার, হাতির ডাক আর ঘোড়ার চিঁহি রবে চারপাশ প্রকম্পিত হতে থাকে। কয়েক মিনিট আগেই ইবরাহিমের বাদক দল ঢাকে যুদ্ধের বোল তুলতে শুরু করেছে।
বাবর ভাবে, সে সত্যিই আক্রমণ করবে। যদি তাই হয়, তবে বাবরের জীবনে আজকের দিনটা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। আর বিজয় লাভের জন্য সম্ভাব্য সব প্রস্তুতি সে নিয়েছে। রাতে সে সামান্যই ঘুমিয়েছে, সারা রাত জেগে নিজের যুদ্ধ পরিকল্পনার দুর্বলতা বা খুঁত খুঁজে বের করতে চেয়েছে। কিন্তু কিছুই পায়নি। তার আর কিছু করার নেই…।
সে বাবুরী আর হুমায়ুনের সাথে শেষবারেরমতো আলাপ করার জন্য তাদের ডেকে পাঠায়। হুমায়ূন আজকের যুদ্ধে ডানপাশের সমরসজ্জার সেনাপতির দায়িত্ব পালন করবে। আর বাবুরী থাকবে বামপাশের দায়িত্বে। যুদ্ধ একবার ভালোমতো শুরু হলে এবং ইবরাহিমের সৈন্যরা বাবরের নির্মিত মাটির প্রতিবন্ধকতা আর গাড়ির বহরের বাধা আক্রমণে ব্যস্ত হয়ে উঠলে তারা দু’পাশ থেকে বৃত্তাকারে তাদের ঘিরে ফেলার জন্য অগ্রসর হবে। তারপরে আল্লাহ সহায় থাকলে বিজয় তাদের নাগালের ভিতরে আসলে তারা তখন পলায়নপর সৈন্যদের নিরন্তর ধাওয়া করে তাদের পুনরায় সংগঠিত হতে বাধা দেবে।
তার সন্তান আর একমাত্র বান্ধব তাদের নিজনিজ অবস্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে, বাবর মাটির দেয়াল রক্ষায় নিয়োজিত সৈন্য পরিদর্শনে বের হয় এবং তাদের ছোট ছোট দলের সাথে কথা বলে। সে সবাইকে একটা কথাই ভালো করে বোঝাতে চায়: “তোমাদের অবস্থানটা সবচেয়ে গৌরবের। তোমরাই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে। মনে সাহস রাখো। নিজের উপরে আর নিজের সুলতানের উপরে বিশ্বাস রাখো। আমাদের নতুন অস্ত্র, কামান আর মাস্কেটের সামর্থ তোমরা দেখেছো। শত্রুর হাত থেকে তাদের সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব তোমাদের উপরে, যাতে সেগুলো ধ্বংস উগরে দিতে পারে।”
একবার সে একদল তরুণ বিচলিত অশ্বারোহী সৈন্যদের একটা জটলা লক্ষ্য করে নিজেদের ঘোড়ার পাশে দাঁড়িয়ে বারবার অস্ত্রশস্ত্র পরীক্ষা করছে। প্রথমবার যুদ্ধযাত্রার কালে নিজের অভিজ্ঞতার কথা আমার মনে আছে। সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার লিলা যুদ্ধ শুরু হবার জন্য অপেক্ষা করাটা। আমি জানি যখন সময় হবে তোমরা সবাই বীরের মতোই লড়বে। সামনের শত্রুর প্রতি মনোনিবেশ করবে, জানবে হযযাদ্ধারা পাশ থেকে তোমাকে ঠিকই আগলে রাখবে।”
প্রতিরক্ষা ব্যুহের আরেক স্থানে সে মাটির প্রতিবন্ধকতার একটা দেয়ালের পাশে ঘোড়া থেকে নামে এবং চুলবিহীন চাদিতে ক্ষতচিহ্ন যুক্ত শক্তপোক্ত দেখতে এক পোড়খাওয়া তীরন্দাজের ধনুকের ছিলা পরখ করে দেখে যে মাটির দেয়ালের পেছনে নিজের অবস্থানে প্রস্তুত রয়েছে। “এই ধনুক দিয়ে কতোদূরে তুমি তীর ছুঁড়তে পারো?”
“সুলতান, পাঁচশ গজ।”
“দারুণ, তোমার মতো পোড়খাওয়া যোদ্ধাকে আমার নিশ্চয়ই অপেক্ষা করার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে না যে, শত্রু সেনা চারশ নিরানব্বই গজ কাছে আসবার পরে তুমি তাদের লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়বে। কিন্তু আমার বোধহয় তোমাকে মনে করিয়ে দেয়া উচিত যে, আমি শুনেছি ওখানে হাতির পাল প্রস্তুতি নিচ্ছে আর তাদের কানের পেছনে বসে থাকা আরোহীদের লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে তুমি আমাকে দারুণ সহায়তা করতে পারো। লোকগুলো মারা গেলে, বিশালাকৃতি প্রাণীগুলো দিকভ্রান্ত হয়ে পড়বে আর নিজেদের লোকদেরই পিষে দিতে শুরু করবে।”
প্রতিবন্ধকতার কেন্দ্রে নিজের নির্ধারিত স্থানে সে ফিরে যাবার আগে তূর্কী গোলন্দাজদের সর্দার আলী কুলীর সামনে শেষবারেরমতো থামে। “নিজের মাতৃভূমি থেকে এতোদূরে ভ্রমণ করে এসে আমার পক্ষে লড়াই করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি জানি যতোই ভীতিকর দেখাক, প্রতিপক্ষের পঞ্চাশটা হাতির সমান আপনার একেকটা অস্ত্র। তাদের পরাস্ত করুন আর আমি আপনাকে যথাযথভাবে পুরস্কৃত করবো।”
বাবর নিজের অবস্থানে ফিরে এসে ঘোড়া থেকে নামে এবং তাঁবুতে প্রবেশ করে নফল নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষ হতে, তার মরহুম আব্বাজান, আম্মিজান, নানীজান, এসান দৌলত, ওয়াজির খান, আর বাইসানগারের চেহারা তার মানসপটে ভেসে উঠে। কেবল এসান দৌলতের অভিব্যক্তিই তার কাছে যোদ্ধার উপযুক্ত মনে হয়। সে নিরবে প্রতিজ্ঞা করে, আজ আমি আপনাদের সবাইকে সম্মানিত করবো। আর প্রমাণ করবো আমি আপনাদের আর তৈমূর এবং চেঙ্গিস খানের উপযুক্ত বংশধর।”
“সুলতান, তারা নিশ্চিতভাবেই এবার আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে।”
বাবরের নিশানবাহক কর্চি তার ভাবনায় ছেদ ঘটায় এবং নিজের নিয়তিকে বরণ করতে সে শান্ত আর আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। তার পরিচারক তাকে ইস্পাতের বর্ম পরিয়ে, কোমরে তার মরহুম আব্বাজানের তরবারি ঝুলিয়ে দেয় এবং হাতে হলুদ আর সবুজ পুচ্ছযুক্ত গম্বুজাকৃতি শিরস্ত্রাণ ধরিয়ে দিয়ে চামড়ার খাপে মোড়ানো একটা খঞ্জর এগিয়ে দেয়। বাবর সেটা তার খয়েরী রঙের চামড়ার ঘোড়সওয়ারের জুতোর উপরের অংশে গুঁজে রাখে।