বাবর সহসা নিজের সামনে খানিকটা খোলা স্থান দেখতে পায়।
সে শত্রুপক্ষের প্রথম সারি অতিক্রম করেছে। তার লোকদের এখন আরও ভেতর প্রবেশ করার বদলে ফিরতি পথে ঘুরে যাওয়া উচিত। নতুবা প্রতিপক্ষের বেষ্টনীর ভিতরে আটকে পড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। নিজের উত্তেজিত ঘোড়ার লাগাম বহুকষ্টে টেনে ধরে সে ফিরে যাবার জন্য। আগে থেকে নির্ধারিত সংকেত ঘোষণা করে এবং তাদের ঘোড়ার কারণে সৃষ্ট ধূলোর মেঘের ভিতর দিয়ে যা ইবরাহিমের লোকদের পুরোপুরি ঢেকে রেখেছে, দুলকিচালে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে চলে।
বাবর জানে ফিরে যাবার জন্য ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয়াটা সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়। যখন তার ধাবমান সৈন্যরা ঘোড়ার মুখ ঘোরাতে গিয়ে একে অপরের সাথে ধাক্কা খেয়ে ইবরাহিমের তীরন্দাজদের সহজ নিশানায় পর্যবসিত হতে পারে। অবশ্য, আশার কথা, তার অশ্বারোহী বাহিনী যথেষ্ট প্রশিক্ষিত এবং দুই একজন যদিও আচমকা ঘোড়ার গতিমুখ পরিবর্তন করতে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে বেশিরভাগই সাফল্যের সাথে ঘোড়ার মুখ উল্টো দিকে ঘুরিয়ে নিতে সক্ষম হয় এবং বাবরকে অচিরেই ধূলো আর বিভ্রান্ত শত্রুসেনার মাঝ দিয়ে পেছনে ধেয়ে আসা তীরের ঝাপটাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের ছাউনির দিকে ঘোড়া ছোটাতে দেখা যায়। আক্রমণ শুরু করার আগে সে যেমন আদেশ দিয়েছিলো, তার লোকেরা অনতিবিলম্বে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং আতঙ্কিত হবার ভান করে ঢাল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এলোপাথাড়ি ঘোড়া ছোটায়।
সমভূমিতে যেমন হয়ে থাকে, বাবর তার ছাউনির গড়ের আড়ালে যখন ঘোড়া থেকে। নামে। ততক্ষণে দ্রুত চারপাশে অন্ধকার নেমে আসছে। তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। বাবুরী সন্ধ্যার আঘো-অন্ধকারের ভেতর থেকে তার দিকে এগিয়ে আসে। তার বাম হাতের আঙ্গুলের গাঁটে একটা সাদা কাপড়ের ফালি শক্ত করে বাঁধা আর সেটাতে রক্তের দাগ ফুটে থাকায় স্পষ্টই বোঝা যায় বেচারা হিন্দুস্তানের তরবারির ধার পরখ করে এসেছে। অবশ্য সে সব পাত্তা না দিয়ে কান পর্যন্ত হাসি নিয়ে সে বাবরের দিকে এগিয়ে আসে।
“তুমি বন্দি নিয়ে এসেছো?”
“এরচেয়ে ভালো নির্ধারণ আর হতে পারে না- কোনো পানির্বাহক না আমি অশ্বারোহী যোদ্ধার একটা দল তাদের দলনেতাসহ নিয়ে এসেছি যাকে পরাস্ত করতে আমাদের ঘাম ছুটে গিয়েছিলো।”
“সেই তাহলে আমাদের বার্তাবাহকের দায়িত্ব পালন করবে। পাঁচ মিনিটের ভিতরে তাকে আমার তাঁবুতে হাজির করো। আর দেখো সে আর তার লোকদের চোখ যেনো বাঁধা থাকে। আমি চাই না ফিরে গিয়ে তারা আমার শিবিরের বর্ণনা দিয়ে বেড়াক।”
পাঁচ মিনিট পরে বাবুরী বন্দিকে বাবরের সামনে নিয়ে আসে। বন্দি কালো বর্ণের বিশাল আকৃতির পেষল দেহের একটা লোক। সে তার দিকে এগিয়ে আসতে, বাবর খেয়াল করে দেখে হিন্দুস্তানীদের প্রিয় ঝাকড়া গোফ রয়েছে লোকটার এবং ভাবে যে তার মাতৃভূমির অনেক লোকের যার ভেতরে সেও অন্তর্ভূক্ত- গোফ রাখার উপযুক্ত দাড়ি রয়েছে।
“তার চোখের বাঁধন অপসারিত করো। তোমার নাম কি?”
“আসিফ ইকবাল।”
“বেশ, আসিফ ইকবাল, আমাকে বলা হয়েছে যে তুমি ভাগ্যবান আর সেই সাথে সাহসীও বটে। সুলতান ইবরাহিমের কাছে একটা বার্তা তুমি বয়ে নিয়ে যাবে।” লোকটার ভেতরে কোনো হেলদোল দেখা যায় না। সে যে কথাটা বুঝেছে সেটা বোঝাবার জন্যও মাথা নত করে কি করে না।
“আজ আমরা যদিও আমাদের আক্রমণ থেকে পিছু হটে এসেছি এবং আমাদের অনেক হতাহত হয়েছে। কিন্তু তুমি তাকে বলবে যে আমরা তাকে সম্মুখ সমরে আহ্বান করছি। আমাদের কাছে সে একটা কাপুরুষ। কারণ সংখ্যায় আমাদের চেয়ে অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও আমাদের আক্রমণ করতে তার সাহস হয়নি। তার কাছে জানতে চাইবে সেনাপতিরা তার কথা শুনবে না বলেই কি তার এই আক্রমণে অনীহা- তুমি তাকে আরও বলতে পারো তার সেনাপতিদের অনেকেই পুরস্কারের বিনিময়ে আমার সাথে যোগ দিবে বলে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। নাকি সে জানে যে তার সেনাবাহিনীতে কাফেরের সংখ্যা প্রকৃত বিশ্বাসীদের চেয়ে বেশি হবার কারণে সে জানে যে আল্লাহতালা তার প্রতি সহায় হবে না? তাকে বলবে ‘হয় আক্রমণ করুক নতুবা আজীবন কাপুরুষ নামটা তাকে তাড়া করে ফিরবে।”
বন্দি সেনাপতির চোখে আবার কালো কাপড় বেঁধে দেয়া হয় এবং ইবরাহিমের ছাউনির কাছে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে এসে, বাবুরী বাবরের তাঁবুতে ফিরে আসে। “আশা করা যায় আমাদের আজকের হামলায় পালিয়ে আসবার ভনিতা করে আমরা যে দুর্বলতা অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে চেয়েছি, আর এই বার্তা ইবরাহিমকে আক্রমণে উৎসাহিত করে তুলবে।”
“দুটোতেই কাজ হবে। কেউ কাপুরুষ সম্বোধন শুনতে পছন্দ করে না। ইবরাহিম ভালো করেই নিজের সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের কথা জানে। আর তার সেনাপতিদের কেউ কেউ গোপনে পক্ষত্যাগ করতে চাইছে এই আভাস পাবার পরে সে তার সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে সংখ্যাধিক্যের সুবিধা নাকচ হয়ে যাবার আগেই আক্রমণ করবে।”
“আমি মানছি সে কথা। আমার লোকদের সকালের আলো ফোঁটার একঘণ্টা আগে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলবে। ইবরাহিম আক্রমণ করলে দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবার আগেই করবে।”
বাবুরী চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে, তারপরে কি মনে হতে সহসা বাবরকে আলিঙ্গন করে। “আগামীকাল আমাদের দুজনের জন্যই একটা ঘটনাবহুল দিন হবে। আমি অনুভব করতে পারছি।”