“ফারগানার ন্যায়সঙ্গত সুলতান, মির্জা বাবরের জয় হোক,” ওয়াজির খানের কণ্ঠস্বর গর্জে উঠে ঘোষণা করে এবং দেহের মাপের চেয়ে বড় হলুদ আলখাল্লা আর লম্বা মখমলের পাগড়ি মাথায় বাবর ভিতরে প্রবেশ করতে সে নিজেকে তার সামনে প্রণত করে। গোত্রপতিদের যারা তার সালতানাত মেনে নিয়েছে তারা তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। সবার চোখে সতর্ক দৃষ্টি, যদি প্রয়োজন পড়ে সেজন্য সবার হাত তরবারির বাঁটে।
বাবরের মনে ক্ষীণ সন্দেহ আছে তারা তার প্রতি বিশেষ কোনো মৈত্রীর বন্ধন অনুভব করে কিনা সেটা নিয়ে। তারা কেবল একটা বাজি ধরেছে। কিন্তু এখন তারা বিজয়ী পক্ষে থাকতে ইচ্ছুক যাতে প্রতিশ্রুত প্রতিদান লাভ করতে পারে।
বিশৃঙ্খলার দিকে তাকিয়ে বাবরের কাছে পুরো দৃশ্যটা হাস্যকর মনে হয়- ভারী শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে থাকা লোকেরা মাটিতে তাকিয়া, মাংসের ঝোল আর পোলাও এ মাখামাখি অবস্থায় পড়ে আছে এবং তাদের পোষা কুকুরের দল হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভোজের সম্মুখীন হয়ে নিজেদের ভিতরে কামড়াকামড়ি করছে। গড়গড় করতে থাকা কুকুরের দলের চেয়ে আন্তরিক বলা যাবে না কামবার আলীর অভিব্যক্তিকে যখন সে ধীরে বাবরের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে কপাল মাটিতে ঠেকায়।
“উজির, আর উপস্থিত সবাই এবার উঠে দাঁড়াতে পারেন।” সুলতান হিসাবে বাবর তার প্রথম আদেশ দেয়ামাত্র নিজের ভিতরে সে একটা আন্ত্রিক উত্তেজনা বোধ করে।
কামবার আলী ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ায়, ভেতরের আতঙ্ক দমনের ব্যর্থ প্রয়াসের লক্ষণ তার চেহারায় স্পষ্ট ফুটে আছে। “সুলতান, আপনার দরবারের সদস্যরা আপনার আদেশ পালনে প্রস্তুত।”
“তাহলে তুমি এটা কিভাবে ব্যাখ্যা করবে- মোঘুলিস্তানের খানের কাছে পাঠান এই আমন্ত্রণপত্র?” বাবর হাত বাড়ালে ওয়াজির খান তার হাতে একটা চামড়ার বাক্স উঠিয়ে দেয়। বাবর ভেতর থেকে একটা কুণ্ডলীকৃত কাগজ বের করে উজিরের চোখের সামনে ধরতে তার ভিতরে কোনো বিকার দেখা যায় না।
“রাজ্যের ভালোর জন্য আমি এটা পাঠিয়েছিলাম।” উজিরের শ্বাস-প্রশ্বাসের বেগ দ্রুত হয়ে উঠেছে।
“নিজের ভালোর জন্য এটা পাঠিয়েছিলে-” ওয়াজির খান ক্রুদ্ধ কণ্ঠে শুরু করতে বাবর হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয়। শাসক হিসাবে এটা তার প্রথম পরীক্ষা এবং সে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চায় নতুবা আগামীকাল, আগামী মাসে বা আগামী বছর কোনো না কোনো সময়ে তাকে তার জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ষড়য়ন্ত্র আবার শুরু হবে।
কামবার আলীর মুখে এখন ক্রোধের আভাস এবং বাবর ভয় আর ঘামের তিক্ত ঘ্রাণ উজিরের ভিতর স্পষ্ট টের পায়। কিন্তু তার মৃত আব্বাজানের কাছে যে লোকটা এত প্রশ্রয় পেয়েছে তার প্রতি সামান্যতম করুণা সে বোধ করে না। কেবল ক্রোধ আর প্রতিশোধের কামনা তাকে জারিত করে।
শাহী জ্যোতিষী, শাহী কোষাধ্যক্ষ আর শাহী বাজারসরকারকে একস্থানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে এবং হতাশায় তাদের চোখ মুখ ঝুলে পড়েছে। তাদের নিয়ে যাও,” বাবর প্রহরীদের আদেশ করে। “আমি পরে তাদের বিষয় বিবেচনা করবো।” দেয়ালের অনেক উপরে স্থাপিত একটা ক্ষুদে জাফরীর দিকে তার নজর যায় এবং মনে হয় জাফরির পেছনে সে একটা নড়াচড়া লক্ষ্য করেছে। সেখানে বসেই রাজকীয় মহিলারা উৎসবে আর ভোজসভায় মার্জিতভঙ্গিতে সবার চোখের আড়ালে থেকে অংশগ্রহণ করেন। সহজাত প্রবত্তির বলে সে বুঝতে পারে সেখানে কারা রয়েছে তার আম্মিজান আর নানিজান সেখান থেকে সুলতান হিসাবে তার প্রথম পদক্ষেপ দেখছে আর তাকে এগিয়ে যেতে অনুরোধ করছে।
তার নিজের কাছেই অবাক লাগে ভাবতে যে এখন সে মানুষের জীবন মৃত্যুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে বহুবার নিজের আব্বাজানকে দেখেছে মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিতে। গত দু’এক বছরে সে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে দেখেছে শিরোচ্ছেদ, চামড়া তুলে নেয়া, ঘোড়া দিয়ে টেনে দেহ টুকরো করে ফেলা। তাদের আর্তনাদ আর রক্তের গন্ধ এখনও তার গলায় সে অনুভব করে কিন্তু যতক্ষণ তা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করছে তার কখনও মনে হয়নি ব্যাপারটায় কোনো অসঙ্গতি রয়েছে।
আর এখন সে নিশ্চিতভাবেই জানে তার মা আর নানীমা তার কাছে ঠিক কি প্রত্যাশা করছেন। তার নামের মানে “বাঘ” আর তাকেও সেই বিশাল মার্জারের দ্রুততায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। “তুমি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছো আমাকে হত্যা করতে চেয়েছো, তাই নয় কি?” সে শীতল কণ্ঠে বলে। কামবার আলী তার চোখের দিকে তাকায় না। বাবর ধীরে ধীরে তার তরবারি কোষমুক্ত করে। “প্রহরী!” সে ওয়াজির খানের দু’জন লোকের উদ্দেশ্যে ইঙ্গিত করতে তারা উজিরকে মাটিতে ঠেসে ধরে তার দু’হাত শক্ত করে দেহের পেছনে চেপে ধরে। তারপরে তারা তার মাথা থেকে পাগড়ি খুলে নেয় এবং আলখাল্লার পেছনটা ছিঁড়ে ফেলে তার গর্দানের পেছনের দিক উন্মুক্ত করে।
উজির গর্দান টান করে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও যে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা সত্ত্বেও তোমাকে আমি দ্রুত মৃত্যু দান করছি।” বাবর টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে, মায়ের কামরায় দাঁড়িয়ে কয়েক ঘন্টা আগে যেমন অনুশীলন করেছিলো তেমনিভাবে একবার তরবারিটা বাতাসে আন্দোলিত করে। সে মনে মনে প্রার্থনা করে, আল্লাহ কাজটা করার শক্তি আমাকে দাও। মাথা যেন নিখুঁতভাবে দ্বিখণ্ডিত হয়। সৈন্যদের হাতের ভিতরে উজির ছটফট করতে থাকে তার চোখে বিষাক্ত দৃষ্টি। বাবর আর একমুহূর্তও ইতস্তত না করে, তরবারি উপরে তুলে ধরে ফলাটা সজোরে উজিরের ঘাড় লক্ষ্য করে নামিয়ে আনে। পাকা তরমুজ দ্বিখণ্ডিত করার মত তরবারির ফলা উজিরের ঘাড়ের শীর্ষ, কোমলাস্থির ভিতর দিয়ে কেটে বের হয়ে আসে। বর্গাকৃতি পাথরের মেঝে, উপর দিয়ে বিচ্ছিন্ন মুণ্ডটা হলুদ দাঁত বের হয়ে থাকা গড়িয়ে যায়, তরল চুনির মত রক্তধারা গড়িয়ে পড়ে।