***
“আপনারা বুঝতেই পারছেন, সম্মানিত ভদ্ৰোমহোদয়গণ, এই বিষয়ে আমাদের বিবেচনার সামান্যই অবকাশ রয়েছে। কামবার আলী তার চেহারায় যথোচিত গম্ভীর হালছাড়া একটা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলে। “এমন কি আজই, আমাদের মহামান্য মরহুম সুলতানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময়েই, উজবেক হার্মাদ সাইবানি খান নরকে যেন স্থান হয় বেজন্মাটার- আমাদের হুমকি দেবার মত ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। কেবল কুটিল উজবেকরাই না, আমাদের রাজ্যের প্রতি আরও অনেকের লোলুপ দৃষ্টি আছে। এই রাজ্য পরিচালনা আর রক্ষা করতে চাইলে শাহজাদা বাবরের মত অল্পবয়সী কিশোরের পরিবর্তে পাশ্ববর্তী রাজ্যের কোনো অভিজ্ঞ শক্তিশালী ব্যক্তিকে আমাদের বেছে নিতে হবে। আমরা কাকে নির্বাচিত করবো সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না… আজ রাতের কোনো এক সময়ে শাহী মন্ত্রণা পরিষদ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার জন্য মিলিত হবে।”
কামবার আলী তার চারপাশে তাকিয়ে বর্গাকার প্রস্তরখণ্ডের মেঝের উপরে নিচু কাঠের টেবিলের পেছনে তাকিয়ার উপরে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে থাকা গোত্রপতিদের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরের ফিসফিস গুঞ্জন শোনে। কি পরিতাপের বিষয় তার বেল্লিক তীরন্দাজ বাবরকে শরবিদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
শাহী দরবারের অন্য সদস্যরা, ইউসুফ, বাবা কাশক, এবং বাকী বেগও চুপ করে দেখে আর অপেক্ষা করে, তাদের সবাই নিজ নিজ পৃষ্ঠপোষককে রাজপ্রতিভূ হিসাবে নিয়োগ দিয়ে প্রাপ্ত উপঢৌকনের সম্ভাব্য পরিমাণ বিশ্লেষণের সুখস্বপ্নে বিভোর।
“আল্লাহ সাক্ষী, এটা হতে পারে না!” ফারগানার পশ্চিমাঞ্চল থেকে আগত গোত্রপতি আলী-দোস্তের কর্কশ কণ্ঠস্বর কামবার আলীর স্বপ্নচারিতায় বিঘ্ন ঘটায়। কাঠবাদামের সসে ঝলসানো আস্ত ভেড়া রাখা কাঠের অস্থায়ী টেবিলের উপরে আলী- দোস্ত সজোরে ঘুসি বসিয়ে দেয়। তার হাতে ধরা তেল চর্বি মাখান মাংস কাটার ছুরিটা সে বাতাসে আন্দোলিত করে। “শাহজাদার বয়স রাজ্য পরিচালনার পক্ষে নিতান্তই অল্প কথাটা সত্যি, আর তাই বলে আগন্তুকের দ্বারস্থ হতে হবে। আমি তৈমূর বংশের সন্তান। আমার বাবা ছিলেন মৃত সুলতানের রক্ত-সম্পর্কের ভাই। আমি একজন পরীক্ষিত যোদ্ধা- গত শীতেই প্রথম তুষারপাতের পরে আমি নিজ হাতে বিশজন উজবেককে হত্যা করেছি আমাদের গবাদি পশুর পালে হামলা করার সময়ে…?! রাজপ্রতিভূ নিযুক্ত করতে হলে আমার চেয়ে যোগ্য কাউকে খুঁজে পাবে না ভেড়ার চর্বি লেপটানো আবেগে লাল হয়ে উঠা মুখে, সে গনগনে চোখে কামরায় উপস্থিত সবার দিকে তাকায়।
“ভাইয়েরা, শান্ত হোন।” বাকী বেগ হাত তোলে সবাইকে শান্ত করার অভিপ্রায়ে কিন্তু কেউ তার বাক্যে কর্ণপাত করে না।
আলী-দোস্ত হাচড়পাঁচড় করে উঠে দাঁড়াতে, তার লোকেরা ক্রুদ্ধ মৌমাছির মত বিড়বিড় করতে করতে তার চারপাশে এসে সমবেত হয়। কিছুক্ষণের ভিতরেই একের পর এক গোত্রপতি নিজের স্বপক্ষে অকাট্য দাবি আর মসনদে নিজের অধিকার জানিয়ে উঠে দাঁড়াতে আরম্ভ করে। আলী-দোস্ত তার গামলার মত হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে তাকে অপমান করেছে ভেবে নিয়ে পাশে দাঁড়ানো একটা লোককে আঘাত করতে চেষ্টা করে এবং লোকটা উল্টে পরতে সে এবার অন্য হাতে ধরা মাংস কাটার ছুরির ডগাটা তার গলায় ঠেকায়। কাঠের অস্থায়ী টেবিলের উপরে কিছুক্ষণ আগে পরিবেশন করা ঘিয়ে ভাজা শুকনো বাদাম দিয়ে রান্না করা মুখরোচক বিরানী আশেপাশের তাকিয়ার উপরে ছিটকে পড়তে শুরু করে।
কামবার-আলী কামরার দূরবর্তী প্রান্তে নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে কামরায় বিদ্যমান বিশৃঙ্খলার দিকে তাকিয়ে থাকেন, তার অভিব্যক্তিতে বিষণ্ণতার কোনো চিহ্ন পরিলক্ষিত হয় না। এসব তথাকথিত যোদ্ধারা সব বাচ্চা ছেলের মত একটা ভেড়া- বা একটা মেয়ে মানুষের জন্য এরা খুন করতে পিছপা হয় না। ওয়াইনের মাদকতায় শুরু হওয়া এই বিশৃঙ্খলা শীঘ্রই প্রশমিত হবে এবং এর ফলে তার পরামর্শের যৌক্তিকতা আরও বৃদ্ধি পাবে। সে তাকিয়ে দেখে তালুকের মত এক গোত্রপতি আরেকজনের গলা চেপে ধরে শূন্যে তুলে তাকে ইঁদুরের মত ঝকাতে থাকে যতক্ষণ না ভরপেট খাওয়া লোকটা সবকিছু তার মুখে উগড়ে দেয়।
“ফারগানার সুলতানের নামে বলছি এসব বন্ধ করো!”
কামবার আলী চমকে ঘুরে তাকায়। বিশাল দরজার নিচে ওয়াজির খান দাঁড়িয়ে আছে আর তার পেছনে বর্ম-পরিহিত প্রহরীর দল। উজিরের মুখে ফুটে উঠা বিদ্রুপের হাসি, কামরার ভিতরে তাদের অবস্থান গ্রহণের সময়ে প্রহরীদের একজনের ধাক্কায় মাটিতে ছিটকে পড়ার সাথে সাথে অদৃশ্য হয়ে যায়। ক্রুদ্ধ দাঙ্গাকারীরা প্রথমে বুঝতে পারে না কি ঘটছে। প্রহরীরা তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে কোষমুক্ত তরবারি চামড়ার ঢালে আঘাত করতে, শাপশাপান্ত করে, ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকা গোত্রপতিরা পরস্পরকে ছেড়ে দিয়ে থিতু হয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে যায়।
“নতুন সুলতানকে অভিবাদন জানাবার জন্য প্রস্তুত হও,” ওয়াজির খান কঠোর কণ্ঠে বলে।
“পরিতাপের বিষয়, এটা আল্লাহর ইচ্ছা যে এই মুহূর্তে আমাদের কোনো সুলতান নেই,” উজির মাটি থেকে কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে তার পরণের আলখাল্লার ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে।
ওয়াজির খান কামবার আলীর শীর্ণ কাধ বজ্রমুষ্ঠিতে চেপে ধরে। “আমাদের সুলতান আছেন। মসজিদে তার নামে খুতবা পাঠ করা হয়েছে। উপস্থিত সবাই এখন মাথা নত কর।” মদের প্রভাবে বিভ্রান্ত লোকগুলো বেকুবের মত তাকিয়ে থাকে। প্রহরীরা দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মাঝে প্রবেশ করে জোর করে তাদের হাঁটু ভেঙে বসিয়ে দেয় এবং যারা সামান্য গাইগুই করে তাদের হাতের তরবারির চ্যাপ্টা প্রান্ত দিয়ে লাঠির মত আঘাত করে।