“তিনি নামাজে বসেছেন। তিনি বলেছেন ফারগানার সুলতান হিসাবে তিনি তোমাকে স্বাগত জানাবেন।”
এক মহিলা ভৃত্য ভিতরে প্রবেশ করে প্রণত হয়। “মালিক, ওয়াজির খান সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করেছেন।”
খুতলাঘ নিগার মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। তিনি আর খানজাদা নেকাবের নিম্নাংশ দিয়ে মুখ ঢাকতে না ঢাকতে ওয়াজির খান ভিতরে প্রবেশ করে। বাবর খেয়াল করে, এইবার সে প্রণত হয় না- সময় এত গুরুত্বপূর্ণ যে সেসব সৌজন্য প্রকাশের আবশ্যিকতা নেই। দীর্ঘদেহী সেনাপতি শাহী আলখাল্লা পরিহিত বাবরের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে সন্তুষ্টির সাথে মাথা নাড়ে। “মহামান্য শাহী পরিবার, মোল্লা আর আমার সৈন্যরা কর্তব্য পালনে প্রস্তুত। কিন্তু, এই মুহূর্তে, কামবার আলীও অন্তে যষ্টিক্রিয়ার ভোজপর্ব শেষে উপস্থিত শোকাহত অভ্যাগতদের সামনে বক্তৃতা দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে তাদের বলবে যে রাজ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন, আর এই বিপর্যয় সামাল দেবার পক্ষে আমাদের সুলতানের বয়স অনেক অল্প। সে তৈমূরের বংশের অন্য কোনো শাহজাদাকে রাজপ্রতিভূ হিসাবে মনোনীত করতে অনুরোধ করবে। গতরাতে মোঘুলিস্তানের খানের কাছে তার পাঠান একটা চক্রান্তপূর্ণ চিঠি আমার প্রহরীদের হস্তগত হয়েছে, যার বিষয়বস্তু তাকে মসনদে অধিষ্ঠিত করান, এছাড়াও উজিরের কুটিল ষড়যন্ত্রের অন্যান্য প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে।”
“কিন্তু আমাদের হাতে এখনও সময় আছে?” খুতলাঘ নিগার হারেমের রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে ওয়াজির খানের বাহু আঁকড়ে ধরে ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চান।
“আমাদের হাতে সময় আছে, কিন্তু শাহজাদাকে এখন আমার সাথে যেতে হবে নতুবা কামবার আলী আমাদের আসল উদ্দেশ্য বুঝে ফেলতে পারে। সে ভেবে বসে আছে শাহজাদা দূর্গে ফিরে এসে আপনার সাথে বসে দোয়া’দরূদ পাঠ করছেন।”
সে এবার বাবরের দিকে তাকায়। “শাহজাদা, অন্য আরেকটা আলখাল্লা দিয়ে নিজেকে অনুগ্রহ করে আবৃত করে নিন।” সে তার হাতে ধরা বাবরের ঘোড়ায় চড়ার ধূলি ধূসরিত আলখাল্লাটা তার দিকে এগিয়ে দিলে বাবর দ্রুত সেটা গায়ে চাপিয়ে নেয়, আর তার আম্মিজান দক্ষ হাতে আলখাল্লার ধাতব বাকলেসগুলো আটকে দিয়ে অভিষেকের পাগড়ির ঢেউতোলা শোভাবর্ধক পালকটা শিরাবরণী দিয়ে ঢেকে দেয়।
তরবারির বাঁটে হাত রেখে ওয়াজির খান বাবরকে তার পেছনে পেছনে বাইরের করিডোরে আসতে ইঙ্গিত করে ঘুরে দাঁড়ায়। খানজাদার পাশ দিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে সে আঙ্গুল দিয়ে ভাইয়ের চিবুকে হাত বুলিয়ে দেয়। তার বোনের চোখে আশঙ্কার ছায়া ভারী উপস্থিতি।
আতপ্ত আর উল্লাসের যুগপৎ উপস্থিতি বাবর নিজের ভিতরে অনুভব করে। আজ সন্ধ্যার ঘটনাবলীর উপরে তার পুরো ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বৃদ্ধ উজিরের ধূর্ততা ছোট করে দেখবার কোনো অবকাশ নেই। ওয়াজির খান সম্ভবত তার এই আশঙ্কা টের পেয়ে মুহূর্তের জন্য দাঁড়ায়। “শাহজাদা, সাহস রাখেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।” “সাহস।” বাবর শব্দটা বিড়বিড় করে উচ্চারণ করার ফাঁকে তরবারির অলংকৃত বাটে আঙ্গুল বুলায়।
তারা অন্ধকারাচ্ছন্ন গলিপথ, তীক্ষ্ণ ধাপযুক্ত প্যাচান সিঁড়ির কুলঙ্গিতে রাখা তেলের প্রদীপের আলোয় কিম্ভুতকিমাকার ছায়ার জন্ম দিতে দিতে দ্রুত এগিয়ে যায়। দূর্গের সবচেয়ে প্রাচীন অংশে মসজিদটা অবস্থিত, বাবরের পূর্বপুরুষদের আদেশে পেছনের পাথুরে পাহাড় খোদাই করে এটা নির্মাণ করা হয়েছে। গুহা-সদৃশ্য পাথুরে প্রকোষ্ঠ কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে- রোদে পোড়ান মাটির ইটের তৈরি ছাদের মত ভঙ্গুর না, যা ধ্বসে পড়ে তার পিতাকে বেহেশতের পথে নিয়ে গিয়েছে।
মসজিদের সামনের ছোট শান্ত উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ওয়াজির খানকে অনুসরণ করে সে উপস্থিত হয়। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে এবং মেঘের আড়াল ছেড়ে চাঁদ বের হয়ে এসেছে। চাঁদের শীতল খাপছাড়া আলোতে সে ওয়াজির খানের ছয়জন প্রহরীকে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তারা নিরবে তাদের সেনাপতিকে অভিবাদন জানায়।
বাবরকে বাইরে অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করে ওয়াজির খান কোরানের আয়াত উত্তীর্ণ করা তীক্ষ্ণ শীর্ষদেশযুক্ত বাঁকান তোরণাকৃতি খিলানের নীচ দিয়ে মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করে। উল্কণ্ঠিত কয়েক মুহূর্ত অতিক্রান্ত হবার পরে সে বাইরে বের হয়ে আসে। “মহামান্য শাহজাদা,” সে মৃদু কণ্ঠে বলে, “আপনি এবার ভিতরে প্রবেশ করতে পারেন।”
বাবর তার উপরের আলখাল্লা খুলে ফেলে ভিতরে প্রবেশ করে। মক্কাশরীফের দিকে মুখ করা মিহরাবের দুপাশে দুটো মশাল জ্বলছে, যেখানে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেব নিরবে নামাজ আদায় করছেন। আবছা আলোতে বাবর প্রায় বিশজনের মত গোত্রপতিকে আসনসিঁড়ি অবস্থায় বসে থাকতে দেখে, প্রতিটা লোক, গোত্রগত মৈত্রীর বন্ধন আর রক্তের সম্বন্ধের কারণে তার প্রতি বিশ্বস্ততা ঘোষণা করতে প্রস্তুত।
মসজিদের ভিতরে উপস্থিত প্রত্যেকের চোখের দৃষ্টি তার উপরে আপতিত, তাকে মাপছে বুঝতে পেরে, বাবর অতীতে- যারা ফারগানার সুলতান ছিলেন তাদের ওজন নিজের উপরে ভারী হয়ে চেপে বসছে অনুভব করে, মনে হয় তার কাঁধ সেই ভারের চাপে বেঁকে যাচ্ছে। বাবর মসজিদের মেঝেতে কালো পাথরে চিহ্নিত স্থানের দিকে এগিয়ে গিয়ে যেখানে তার পিতা ফারগানার মরহুম সুলতান নামাজ পড়তেন সেখানে আনত হয়ে পরম শ্রদ্ধায় পাথরের শীতল মেঝেতে কপাল স্পর্শ করে। বাইরের তারকাশোভিত আকাশে একটা প্যাচা তীক্ষ্ণ শব্দ করে উড়ে যেতে, ইমামসাহেব খুতবা পাঠ আরম্ভ করেন, যে নসিহতে বাবরকে আল্লাহতালা আর পৃথিবীর সামনে ফারগানার সুলতান হিসাবে অভিহিত করা হবে।