***
“বাছা, কেমন অভিজ্ঞতা হল।” খুতলাঘ নিগারের চেহারায় পরিশ্রান্তভাব, অবিরাম কান্নার কারণে চোখ রক্তজবার মত লাল। হারেমের অনেক ভেতর থেকে বাবর চাপাকান্না ভেসে আসার শব্দ শোনে। মৃত সুলতানের জন্য হারেমের সবাই শোকের কৃত্যানুষ্ঠান পালন করছে। বিষাদের এই রোলের ভিতরে অদ্ভুত একটা ঐক্যতান রয়েছে, যেন কোনো মহিলাই সাহস পায় না প্রথমে কান্না থামাবার।
“সবকিছু নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হয়েছে।” সে সিদ্ধান্ত নেয় আম্মাজানকে তীরের কথা বলবে না- অন্তত এখনই না। জীবনে এই প্রথম সে মায়ের কাছে কিছু গোপন করলো। কিন্তু তার প্রাণ সংশয় দেখা দিয়েছিলো এটা জানতে পারলে তিনি আতঙ্কিত হয়ে উঠবেন।
“আর তোমার মরহুম আব্বাজান। তিনি শান্তিতে সমাহিত হয়েছেন?”
“হ্যাঁ, মা। আমরা সবাই তার জন্য মোনাজাত করেছি, তাকে যেন বেহেশত নসীব করা হয়।”
“এবার তাহলে দুনিয়াদারির কাজের তদারকি শুরু করতে হয়।” খুতলাঘ নিগার হাতে তালি দিলে, তার ব্যক্তিগত পরিচারিকা ফাতিমা ছায়ার ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। তার হাতে হলুদ রেশমের উপরে সোনা আর রূপার জরি দিয়ে ফুলের নক্সা তোলা একটা আলখাল্লা আর একই কাপড়ের একটা পাগড়ি যার উপরে একটা ময়ূরের পালক গোঁজা রয়েছে। খুতলাঘ নিগার বিম্র চিত্তে আলখাল্লাটা তার হাত থেকে নেয়। “এটা ফারগানার সুলতানদের মসনদে অভিষেকের আলখাল্লা। এর আমেজ অনুভব করো, এটা এখন তোমার।”
বাবর হাত বাড়িয়ে ভাঁজ করা চকচকে আলখাল্লাটা স্পর্শ করে এবং গর্বের একটা শিরশিরে অনভূতি তার ভিতরে ছড়িয়ে যায়। সুলতানের আলখাল্লা- তার আলখাল্লা। রেশমের শীতল পরশ তার আঙ্গুলের ডগায় ছড়িয়ে পড়ে।
তার স্বপ্নবেশের চটকা ঘোড়ার খুরের সম্মিলিত বোলে ভেঙে যায়। বাবর জানালা থেকে নিচের বৃষ্টিস্নাত আঙ্গিনার দিকে তাকায়। সন্ধ্যে প্রায় হয়ে এসেছে এবং রাত্রির প্রস্তুতি হিসাবে ইতিমধ্যে মশাল জ্বালান হয়েছে। সে ওয়াজির খান আর মোল্লাকে ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় দূর্গে প্রবেশ করতে দেখে। তাদের ঘোড়াগুলো ঘন ঘন নাক টানে আর তাদের গা থেকে ভাপ বের হয়। শীঘ্রই বাকি শবানুগামীরা দূর্গে ফিরে আসবে আর তারপরেই তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাহেন্দ্রক্ষণ যা তাকে এই আলখাল্লা পরিধানের অধিকার দান করবে। বাবর মুখ তুলে তার মায়ের দিকে তাকায়। তার চোখে শঙ্কার ছায়া ফুটে থাকলেও অভিব্যক্তিতে দৃঢ়তার ছাপ। “জলদি করো,” খুতলাঘ নিগার বলেন। “আমাদের হাতে সময় বড় কম। আলখাল্লাটা তোমার বড় হবে কিন্তু এটা দিয়েই আমাদের কাজ চালিয়ে নিতে হবে।” তিনি ফাতিমার সাহায্যে বাবরের গায়ে আলখাল্লাটা পরিয়ে পরিকর দিয়ে সেটা শক্ত করে কোমরের কাছে বেঁধে দেন এবং তার পরে তার মাথার লম্বা কালো চুলে পাগড়িটা পরান। “দেখি আমার ছেলেকে? এই মুহূর্তে তুমি কেবল একজন শাহজাদা বটে, কিন্তু চাঁদ উঠার পরেই তুমি হবে ফারগানার সুলতান।” তিনি তার সামনে একটা চকচকে পিতলে বাঁধান আয়না তুলে ধরলে বাবর সেখানে নিজের। কঠোর, হয়তো সামান্য বিস্মিত মুখের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠতে দেখে।
“খানজাদা!” তার মা চেঁচিয়ে বাবরের বোনকে ডাকেন। মসনদের দাবি ঘোষণার সময়ে বাবরের পোশাক এবং অন্যান্য অনুষঙ্গ কি হবে সে বিষয়ে স্পষ্টতই বোঝ যায় তিনি যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করেছেন। তার বোন বাইরে অপেক্ষা করছিল এবং করিডোরে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে মায়ের ডাকের প্রতীক্ষায় ছিল। সে দ্রুত কামরার ভিতরে প্রবেশ করে। সবুজ মখমলে মোড়ান একটা লম্বা, সরু বস্তু তার হাতে ধরা। যত্নের সাথে সে তার হাতের জিনিসটা নামিয়ে রেখে সামান্য নাটকীয় ভঙ্গিতে মখমলের ভাজটা সরিয়ে ভেতরের কোষ থেকে একটা বাঁকান তরবারি বের করে আনে।
খুতলাঘ নিগার সেটা নিয়ে বাবরের দিকে বাড়িয়ে ধরেন। “ফারগানার প্রতীক, ন্যায়বিচারের তরবারি- আলমগীর।”
সাদা জেড পাথরের উপরে নানা দামী রত্নে খচিত ঈগলের মাথার মত বাঁটটা দেখামাত্র বাবর চিনতে পারে। পাখিটার বিস্তৃত ডানা মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের বিভঙ্গ লাভ করেছে আর বাঁটের উপরে উঁচু হয়ে থাকা চুনির চোখ সম্ভাব্য আক্রমণকারীর দিকে শাণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তার মৃত আব্বাজানের হাতে সে বেশ কয়েকবারই এটা দেখেছে তিনি অবশ্য তাকে এটা কখনও স্পর্শ করতে দিতেন না। “প্রথমবারের মত নিজের হাতে ধরতে পেরে বেশ ভাল লাগছে।” সে বাঁটটা ধরে অদৃশ্য শত্রুর উদ্দেশ্যে সেটা কয়েকবার বাতাসে আন্দোলিত করে।
“তোমার বাবার রেখে যাওয়া সম্পদের ভিতরে এটা অন্যতম। লোকে বলে চোখের চুনি দুটো তৈমূরের, তিনি দিল্লী থেকে পাথর দুটো নিয়ে এসেছিলেন। ফারগানার নতুন সুলতান হিসাবে এখন থেকে তুমি এগুলোর মালিক।” খুতলাঘ নিগার তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে তরবারির মণিমুক্তা খচিত খাপটা তার কোমরের সাথে আটকে দেয়, যে ইস্পাতের শিকলের সাহায্যে সেটা ঝুলছে তার দৈর্ঘ্য ঠিক করে দেয়।
“নানিজান কোথায়?” এসান দৌলতকে আশেপাশে কোথাও দেখা যায় না এবং বাবর এই সময়ে তার উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভব করে। সে মনে মনে চায় তিনি তাকে সুলতানের এই বেশে দেখুক তাকে অবিকল সুলতানের মত দেখাচ্ছে বলে মন্তব্য করুক।