“বেজন্মা উজবেক,” অবজ্ঞার সাথে একজন সৈনিক চেঁচিয়ে উঠলেও, বাবর তার চোখে আশঙ্কার মেঘ জমা হতে দেখে।
“এসবের অর্থ কি?” শাহী জ্যোতিষী হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে ওয়াজির খানের হাত থেকে চামড়ার টুকরোটা ছিনিয়ে নেয়। বাকী বেগ হুমকিটা পড়ে এবং বাবর তাকে আঁতকে উঠে সশব্দে শ্বাস নিতে শুনে। ছোটখাট মানুষটা পায়ের ডিমের উপরে দাঁড়িয়ে, মুষ্টিবদ্ধ হাতে সামনে পেছনে দুলতে শুরু করে এবং তার কীচকী কণ্ঠ থেকে একটা বিলাপ উথলে উঠে: “সাইবানি খান আসছে, সেই এলাচি খুনী…আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি…সে একটা বিশাল কালো ঘোড়ার পিঠে বসে রয়েছে যার খুরের দাপটে মানুষের খুলি গুঁড়িয়ে যাচ্ছে।” তার বিলাপ এবার চিল চিল্কারে পরিণত হয়: “সাইবানি খান আসছে! তার পেছনে ধেয়ে আসছে মৃত্যু আর মহামারী!”
কামবার আলীও ইতিমধ্যে বাবরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তার পেছনেই আছে শাহী কোষাধ্যক্ষ আর বাজারসরকার। তারা তিনজনই মাথা নাড়তে থাকে। “অন্তেষ্টিক্রিয়ার ভোজ শেষ হবার পরে আজ রাতেই শাহী পরামর্শকের দল বৈঠকে বসবে। সাইবানি খান মিথ্যা হুমকি দেবার পাত্র না,” উজির বলেন। ইউসুফ আর বাবা কাশক প্রবল বেগে মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে। তাদের সাথে এবার বাকী বেগও তাল মিলিয়েছে।
ওয়াজির খান সম্মতি প্রকাশের কোনো ধরণের অভিব্যক্তি করা থেকে বিরত থাকে। তার বদলে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কামবার আলীর দিকে তাকিয়ে থাকলে উজির বেচারা অস্বস্তির ভিতরে পড়ে। “শ্রদ্ধেয় উজির, জনগণকে শান্ত করতে আপনি নিশ্চয়ই তাদের উপরে আপনার সন্দেহাতীত প্রভাব খাটাবেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমার সৈন্যরা আপনার তত্ত্বাবধায়নে সদা প্রস্তুত থাকবে।”
“তোমার কথা যুক্তিসঙ্গত, ওয়াজির খান। আবারও তোমাকে ধন্যবাদ জানাই।” কামবার আলী তার পাগড়ী পরিহিত মাথাটা কাত করে কথাটা বলে দ্রুত বিদায় নিলে অন্যান্য অমাত্যরা পঙ্গপালের মত তাকে অনুসরণ করে। বাবর শুনতে পায় বাকী বেগ তখনও আসন্ন বিপর্যয় সম্পর্কে বিড়বিড় করছে, দমকা হাওয়ার মত বিরক্তি তাকে ঘিরে ধরে। সে একবার শুধু মসনদে অধিষ্ঠিত হোক, এই মেরুদণ্ডহীন ক্লিবটাকে দূর করে অন্য কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিগত জ্যোতিষী হিসাবে নিয়োগ করবে। তার বাবা কেন এই লোকটাকে এত খাতির করতেন সেটা তার কাছে একটা রহস্য- আসলেই এত জ্যোতিষী থাকতে এই অপদার্থটাকে কেন বেছে নিয়েছিলেন। বাকী বেগের পরিবার হয়ত কখনও তার উপকার করেছিলো, যার প্রতিদান দেয়াকে তিনি নিজের কর্তব্য বলে বিবেচনা করেছিলেন।
আপাতত আক্রমণের আর কোনো সম্ভাবনা না থাকায়, শবানুগামীরা ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে আলখাল্লার ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে বের হয়ে আসে। সাইবানি খানের নাম মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তেই, বাবর তাদের কাউকে এমন আর্তস্বরে বিলাপ করতে শোনে, যেন তাদের ভবিতব্য ইতিমধ্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে। সে ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে তাদের অজান্তে সূর্যকে ঢেকে দিয়ে দিগন্তের উপর দিয়ে মেঘের দল উড়ে এসে মাথার উপরে জড়ো হয়েছে। নিজের ঊর্ধ্বমুখী কপালে সে বৃষ্টির ফোঁটা অনুভব করে।
“শাহজাদা।” ওয়াজির খান আবার তাকে ধরে ঝাঁকি দেয় এবার এত জোরে যে তার মনে হয় কাঁধের কাছ থেকে পুরো হাতটাই খুলে আসবে। কণ্ঠস্বরে জরুরি ভাব ফুটিয়ে সে ফিসফিস করে কথা বলে: “সাইবানি খানের হুমকি। তার পক্ষে এটা কিভাবে সম্ভব? পাহাড়ের অন্যপ্রান্তে এত দ্রুত সুলতানের মৃত্যুর খবর সে কিভাবে পেলো। আমার মনে হয় এটা ভেতরের কারো কাজ, সম্ভবত কামবার আলীর যোগসাজশে এটা ঘটান হয়েছে। সে সম্ভবত আপনাকে খুন করার পায়তারা করছে। নিদেনপক্ষে, সে মানুষের মনে একটা আতঙ্কের জন্ম দিতে চায়, যাতে একজন কিশোরকে সুলতান হিসাবে গ্রহণ করার ব্যাপারে তাদের ভিতরে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এতে আমাদের পরিকল্পনার কোনো হেরফের হবে না। দূর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। পথে কোনো কারণে বা কারো জন্য ঘোড়ার গতি হ্রাস করবেন না। আমি যতদ্রুত পারি আপনাকে অনুসরণ করছি।”
ওয়াজির খানের উদ্বেগ বাবরের ভিতরেও সংক্রামিত হয়। সে তার ঘোড়া নিয়ে আসতে বলে এবং দ্রুত পর্যাণে উপবিষ্ট হয়। এক মুহূর্তের জন্য ওয়াজির খান তার ঘোড়ার লাগাম ধরে থাকে। “শাহজাদা, আর কয়েক ঘণ্টা তারপরে সব ঠিক হয়ে যাবে,” সে বলে। তারপরে, দেহরক্ষী বাহিনীর একটা দলকে বাবরের সাথে যাবার নির্দেশ দিয়ে সে ঘোড়ার মসৃণ পশ্চাদ্ভাগে একটা চাপড় বসিয়ে দিতে ঘোড়ার খুরে ছন্দের বোল উঠে।
বৃষ্টি আরো জোরে পড়তে শুরু করলে এবং বাড়ন্ত ঘাসের ঝোঁপের মাঝ দিয়ে দুলকি চালে এগিয়ে যাবার সময়ে, বাবর কাঁধের উপর ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। সে কামবার আলীকে উত্তেজিত জনতার মাঝে দু’হাত উঁচু করে এগিয়ে যেতে দেখে। সে আসলে কি চায়? তাদের শান্ত করতে না উত্তেজনা আরো উসকে দিতে? তার সহজাত প্রবর্তনা বলছে ওয়াজির খানের বিশ্লেষণে কোনো ফাঁক নেই: যে দুরাত্মার হাত তীরটা ছুঁড়েছে সেটা কোনো উজবেকের হাত হতে পারে না।
বাবর তার ফারের মোটা ওভারটিউনিকের পকেটের গভীরে হাত দিয়ে তীরটা বের করে নিয়ে আসে। ঘোড়ার লাগাম দাঁতে কামড়ে ধরে সে তীরটা দ্বিখণ্ডিত করে এবং চরম অবজ্ঞার সাথে সেটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে। দ্বিখণ্ডিত তীরটা মাটিতে পড়ে থাকা ভেড়ার লাদির উপরে গিয়ে পড়ে।