মূর্চ্ছাপ্রবণতা আর বিবমিষা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। বাবর চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে নিজেকে সামলে নিতে চায়। অল্পবয়সের অনভিজ্ঞতা আর এখনও অজাতশত্রু হওয়া সত্ত্বেও, তাকে প্রাপ্তবয়স্ক একজন পুরুষের ভূমিকা পালন করতে হবে। ফারগানার মসনদ তার হবে যদি সে আগামী কয়েক ঘণ্টা, সাহসিকতার সাথে নিজের ভূমিকা পালন করতে পারে। তৈমূরের রক্ত তোমার ধমনীতে বহমান। সে তার বাবার প্রায়শই অসীম গর্বের সাথে উচ্চারিত বাক্যটা নিরবে মনে মনে আউড়ায়। শব্দগুলো তার মস্তিষ্কে অনুরণিত হতে থাকলে বহু বহুকাল পূর্বে সংঘটিত মহান গৌরবময় যুদ্ধের আর অনাগত অভিযানের ছবি তার মানসপটে ভেসে উঠে। স্থিরসংকল্পে জারিত মন তার রক্ত শাণিত করে তোলে- এর সাথে যুক্ত হয় কিছু মানুষ তার যুক্তিসঙ্গত দাবি আগ্রাহ্য করতে চায়, সেই ক্রোধ।
অন্তেষ্টিক্রিয়ার শোভাযাত্রা নিয়ে রওয়ানা হবার ঠিক আগমুহূর্তে খুতলাঘ নিগার বাবরের আলখাল্লার বেগুনী রঙের পরিকরে যে রত্নখচিত বাঁটযুক্ত খঞ্জরটা খুঁজে দিয়েছে সেটার ভার অনুভব করে এবং সেটার বাঁটে আঙ্গুল চেপে বসতে তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসে। চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে সে চারপাশে তাকায়। ওয়াজির খানের লোকেরা সমাধি গর্ভে উপস্থিত আছে। তারা নিশ্চয়ই আততায়ীর হাতে তাদের শাহজাদার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না। নাকি তারাও বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে? প্রহরীদের মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে তাদের কারো সম্বন্ধেই তার কোনো ধারণা নেই। মাত্র গতকালও পরিবারের প্রতি তাদের আনুগত্যের বিষয়টা তার কাছে ছিলো প্রশ্নাতীত। কিন্তু আজ পুরো বিষয়টাই পাল্টে গিয়েছে। তার আঙ্গুল খঞ্জরের বাঁট আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে।
সে জোর করে তার মনোযোগ আবার মোল্লার উপরে নিবদ্ধ করে। যিনি তার গভীর, সুরেলা কণ্ঠে তেলাওয়াত করছেন: “আল্লাহ পরম করুণাময়। আমাদের সুলতান উমর-শেখের আত্মা যেন বেহেশতের উদ্যানে এখন অধিষ্ঠিত থাকে। আমরা যারা তার পেছনে রয়ে গিয়েছি তাদের বিষণ্ণতা যেন মুক্তোবিন্দু হয়ে ঝরে এবং আমরা যেন এটা ভেবে উল্লসিত বোধকরি যে আমাদের সুলতান এখন পরম প্রশান্তির বারিধারা পান করছেন।” সে মোনাজাত শেষ করে এবং হাত ভাঁজ করে নিয়ে শবাধার থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঢালু করিডোর দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করলে, দর্শনার্থীরা বহুকষ্টে দু’পাশে ভাগ হয়ে গিয়ে তাকে বাইরে যাবার পথ করে দেয়।
বাবর এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে এবং তার প্রিয় আব্বাজানকে নিরবে বিদায় জানায়। তারপরে কোনোমতে অশ্রু চেপে রেখে সে মোল্লাকে অনুসরণ করে চোখ পিটপিট করতে করতে সূর্যালোকে বের হয়ে আসে। বাম কান ঘেষে উড়ন্ত পাখির ডানা ঝাপটানোর মতো একটা শব্দ তাকে চমকে দিতে সে লাফিয়ে পেছনে সরে আসে। বাজপাখি দিয়ে কেউ এই অসময়ে শিকার করছে? সে চারপাশে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখতে চায় ফারগানার সুলতানকে তার সমাধিসৌধে অন্তিম শয়ানে শায়িত করার সময়ে বাজপাখি উড়ায়, কার এতবড় স্পর্ধা। বাঁকানো ঠোঁটে শিকারের খুবলে নেয়া অংশ এবং পায়ের নখে রেশমের বেণী করা ফিতে ঝোলানো, উজ্জ্বল চোখ আর গলায় অলঙ্কৃত কলারের কোনো পাখি সে দেখতে পায় না। তার বদলে নীল কালো পালকশোভিত, লম্বা শরযষ্টির একটা তীর বাবরের পায়ের কাছে মাটিতে গাঁথা অবস্থায় তিরতির করে কাঁপছে। আর কয়েক ইঞ্চি তাহলেই তীরটা তার দেহে বিদ্ধ হতো।
উপস্থিত লোকজনের ভিতরে আতঙ্কিত শোরগোল শুরু হয় এবং হুড়োহুড়ি করে ঝোপঝাড় আর গাছের পেছনে আশ্রয় নিতে ছুটোছুটি আরম্ভ করার আগে, সবাই বিভ্রান্ত চোখে আকাশের দিকে তাকায় যেন বিকেলের আকাশ অন্ধকার করে এক পশলা তীর তাদের এখনই বিদ্ধ করবে। গোত্রপতিরা নিজ নিজ অনুচরকে ঘোড়া আনতে বলে, ধনুক আর তূণীরের দিকে হাত বাড়ায়। ভোজবাজির মত ওয়াজির খান কখন যেন বাবরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে, নিজের দেহ দিয়ে তাকে আড়াল করে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশের দৃশ্যপট জরিপ করছে। আশেপাশের বিরান সমভূমিতে লুকিয়ে থাকার জায়গা অল্পই আছে, কিন্তু একটা নিঃসঙ্গ পাথর বা বিচ্ছিন্ন ঝোঁপের পেছনে সহজেই একজন আততায়ী ধনুর্ধর লুকিয়ে থাকতে পারে যার হাতে রয়েছে। কসাইয়ের নিপূণতা আর অন্তরের হত্যার জীঘাংসা। ওয়াজির খান তার দাস্তানা পরা। হাত দিয়ে জোরাল একটা ইঙ্গিত করতেই অশ্বারোহী প্রহরীদের একটা দল সম্ভাব্য আততায়ীর খোঁজে বেরিয়ে পড়ে।
“শাহজাদা, এই মুহূর্তে আপনার প্রাসাদে ফিরে যাওয়া উচিত।”
বাবর তখনও সম্মোহিতের দৃষ্টিতে তীরটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। “দেখো,” সে ঝুঁকে মাটিতে গেঁথে থাকা তীরটা তুলে নিয়ে বলে, “পালকের চারপাশে কিছু একটা আটকানো রয়েছে।” সে মোটা লাল সূতার বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে যা পার্চমেন্টের একটা টুকরো তীরের সাথে আটকে রেখেছিল এবং সেটাতে লেখা হুমকির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মাতৃভাষা তুর্কীতেই চামড়ার ফালিতে লেখা রয়েছে কিন্তু অক্ষরগুলো তার চোখের সামনে লাফাতে থাকার কারণে তার এক মুহূর্ত সময় লাগে লেখাটার অর্থ উপলব্ধি করতে।
ওয়াজির খান পার্চমেন্টটা তার হাত থেকে কেড়ে নেয় এবং তাতে যা লেখা রয়েছে সেটা উচ্চকণ্ঠে পড়ে শোনায়: “পৃথিবীর অধিশ্বর পরাক্রমশালী সাইবানি খান তার শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছে। তিন চন্দ্রমাসের সময় অতিক্রান্ত হবার আগেই তিনি ফারগানা নামে পরিচিত খোয়াড়ের দখল বুঝে নিয়ে এর সিংহাসন মূতে ভাসিয়ে দেবেন।”