জবাবে মাথা নেড়ে সায় দিলাম কেবল। উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে আলতো করে একবার চাপ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ইন্দিরা।
এখন আমি আর অ্যালিসিয়া সম্পূর্ণ একা।
তার বিছানার বসে হাতে হাত রাখলাম। অন্য হাতটার উল্টোপিঠে একটা ক্যাথেটার লাগানো। খুব সাবধানে ওর হাতের তালুতে আঙুল বুলালাম। শুকনো হাতটার শিরা-ধমনীগুলো অনুভব করতে পারছি। কব্জির এখানটাতেই ছুরি দিয়ে পোছ দিয়েছিল আত্মহত্যা করার জন্যে।
এভাবেই তাহলে অ্যালিসিয়ার গল্পের ইতি ঘটার কথা ছিল? আবারো নীরবতা নেমে আসলো তার জীবনে। চিরদিনের জন্যে।
ডায়োমেডেস কী বলবেন কে জানে। ক্রিস্টিয়ান নিশ্চয়ই আমাকে দোষারোপ করার কোন না কোন পদ্ধতি খুঁজে বের করবে। আমি তাকে বেশি চাপ দিয়েছি দেখেই হাইড্রোকোডোন জাতীয় কিছু খেয়েছে সে। দুর্ঘটনাবশত ওভারডোজ হয়ে গেছে, ডায়োমেডেস হয়তো পাল্টা যুক্তি দেখাবেন। কিন্তু আত্মহত্যার প্রবণতা তো অ্যালিসিয়ার আগে থেকেই ছিল। এভাবেই এই নাটকের পর্দা নামবে।
আসলেই কি?
একটা বিষয় কারোই নজরে আসেনি। এমনকি অ্যালিসিয়াকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করার সময় ইউরিও ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। ওর ডেস্কে ওষুধের একটা খালি শিশি ছিল, সেখান থেকে কয়েকটা পিল নিচেও পড়ে যায়। সুতরাং আপাত দৃষ্টিতে এটা ভাবাটাই স্বাভাবিক যে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে অ্যালিসিয়া।
কিন্তু আমার আঙুলের নিচে ওর কব্জির কাছে ছোট্ট এই ক্ষতটা তো অন্য কিছুর সাক্ষ্য দিচ্ছে।
হাইপোডার্মিক নিডলের ছাপটা আমার নজর এড়ালো না। সিরিঞ্জের সুই বিধলে এরকমটা হয়। সত্যটা বুঝতে কোন কষ্ট হলো না আমার। আত্মহত্যা করার জন্যে এক শিশি ওষুধ সাবাড় করেনি অ্যালিসিয়া। তাকে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ মরফিনের একটা ভোজ দেয়া হয়েছে।
এটা আত্মহত্যার চেষ্টা বা ড্রাগ ওভারডোজ নয়।
কেউ খুন করতে চেয়েছে অ্যালিসিয়াকে।
.
৪.১৮
আধা ঘন্টা পর গ্রোভে উপস্থিত হলেন ডায়োমেডেস। ট্রাস্টের সাথে নাকি একটা জরুরি মিটিংয়ে ছিল তার। এরপর হাসপাতালে আসার পথে পাতাল ট্রেনে আধাঘন্টার মত আটকে থাকেন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে। ইউরিকে পাঠান আমাকে নিয়ে নিতে।
“প্রফেসর এসেছেন। স্টেফানির সাথে কথা বলছেন এখন। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে সবাই,” আমার অফিসে এসে বলে ইউরি।
“ধন্যবাদ। আসছি আমি এখনই।”
কথা শোনার জন্যে তৈরি হয়েই ডায়োমেডেসের অফিসের দিকে রওনা দিলাম। পুরো ঘটনার জন্যে ট্রাস্টের সামনে বলির পাঠা হিসেবে হাজির করানো হবে কাউকে না কাউকে। এর আগে ব্রডমুরেও এমনটা হতে দেখেছি। সাধারণত রোগির ঘনিষ্ঠ কোন স্টাফকে দোষি সাব্যস্ত করা হয়ে; সেটা ডাক্তার, নার্স কিংবা থেরাপিস্ট যে-ই হোক না কেন। স্টেফানি যে আমার পেছনে লাগবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
দরজায় একবার নক করে ভেতরে প্রবেশ করলাম। স্টেফানি আর ডায়োমেডেস ডেস্কের দু’পাশে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন। কোন বিষয়ে তর্ক হচ্ছিল দু’জনের।
প্রথমে ডায়োমেডেস কথা বললেন। গতানুগতিকের চাইতে অনেক বেশি বিচলিত মনে হচ্ছে তাকে। কথা বলার সময় দুই হাত জোরে জোরে নাড়ছেন। “খুব খারাপ হলো ব্যাপারটা। খুবই খারাপ। তা-ও এরকম একটা সময়ে। এই ঘটনার অজুহাত দেখিয়ে ট্রাস্টের তরফ থেকে গ্রোভ বন্ধ করে দেয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।”
“এ মুহূর্তে ট্রাস্টের চাইতেও অন্যান্য জরুরি বিষয় নিয়ে ভাবা উচিৎ আমাদের,” স্টেফানি বলল ক্রোধান্বিত কণ্ঠে। “রোগিদের নিরাপত্তার সবকিছুর উর্ধ্বে। ঠিক কি ঘটেছিল তা খুঁজে বের করতে হবে আমাদের,” আমার দিকে ঘুরলো সে। “ইন্দিরা বলছিল আপনি নাকি এলিফকে সন্দেহ করছেন? তার মাধ্যমেই হাইড্রোকোডোনের ব্যবস্থা করেছে অ্যালিসিয়া?”
তৎক্ষণাৎ কোন জবাব দিলাম না। কিছুক্ষণ ভেবে বললাম, “আসলে আমার কাছে কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু কয়েকজন নার্সকে এ বিষয়ে কথা বলতে শুনেছিলাম। তাছাড়া একটা বিষয় আপনাদের বিবেচনা করা উচিৎ-”
মাথা ঝাঁকিয়ে আমাকে থামিয়ে দেয় স্টেফানি। “আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, তা বুঝতে পারছি। এলিফের কোন দোষ নেই এখানে।”
“আসলেই?”
“নার্স স্টেশনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ক্রিস্টিয়ান দেখে যে ড্রাগ কেবিনেট হাট করে খোলা। সে মুহূর্তে স্টেশনে কেউ ছিল না। ইউরি দরজায় তালা না দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। সুযোগ বুঝে যে কেউ সেখানে ঢুকে ওষুধ হাতিয়ে নিতে পারতো। তখন অ্যালিসিয়াকেও আশপাশে ঘুরঘুর করতে দেখেছে ক্রিস্টিয়ান। সন্দেহ হলেও কিছু বলেনি। কিন্তু এখন ঘটনা পরিস্কার।”
“হাসপাতালে এত স্টাফ থাকতে ক্রিস্টিয়ানের নজরেই পড়লো ব্যাপারটা।”
আমার কণ্ঠে বিদ্রুপের আভাস থাকলেও স্টেফানি সে বিষয়ে কোন মন্তব্য করলো না। “ইউরির বেখেয়ালিপনা আমিও লক্ষ্য করেছি অনেকবার। নিরাপত্তার বিষয়ে কখনোই অতটা পাত্তা দেয়নি সে। রোগিদের সাথে বন্ধুদের মতন মেশে। মিশুক, সেটায় কোন সমস্যা নেই। কিন্তু অতিরিক্ত বন্ধুসুলভ ব্যবহার করলে তো বিপদ। আরো আগেই এরকম কিছু ঘটতে পারতো।”
“বুঝতে পারছি আপনার কথা,” আসলেও বুঝতে পারছি। স্টেফানি কেন আমার সাথে নরম সুরে কথা বলছে সেটা পরিস্কার। ইউরিকে বলির পাঠা বানানো হবে, আমাকে নয়।