আবারো হাঁটতে শুরু করলো সে, তবে এবারে আর পিছু নিলাম না আমি। ঘোর কেটে গেছে। হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল পাথরটা। গাছের আড়াল থেকে লক্ষ্য রাখছি লোকটার ওপরে। একটা বাড়ির সামনে গিয়ে থামলো সে। এরপর পকেট থেকে চাবি বের করে নিজেই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল।
কিছুক্ষণ পর আলো জ্বলে উঠলো রান্নাঘরে। জানালার সামনেই এখন দাঁড়িয়ে আছে সে। তবে রাস্তা থেকে ভেতরের পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। কারো সাথে কথা বলছে লোকটা, হাতে ওয়াইনের বোতল। এসময় তার সঙ্গিকে দেখলাম এক ঝলক। আমার বয়সী এক নারী। ইনিই কি লোকটার স্ত্রী? পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি না অবশ্য তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো হারামজাদা।
বাহ, বাইরে একজন, ভেতরে আরেকজন।
তার মানে আমি একাই যে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার, এমনটা নয়। আমার স্ত্রীর সাথে ফষ্টিনষ্টি করে এসে এই মহিলার বানিয়ে রাখা খাবার খাচ্ছে সে, যেন কিছুই হয়নি। এভাবে চুপচাপ সব সহ্য করে যাওয়া সম্ভব না আমার পক্ষে। কিন্তু করবোটা কি? মনে মনে যতই খুন করার কথা ভাবি, আদতে তো আমি খুনি নই। তাকে হত্যা করা সম্ভব না আমার পক্ষে।
অন্য কোন ফন্দি আঁটতে হবে।
.
৪.১৭
ভেবে রেখেছিলাম, সকালে অফিসে গিয়েই অ্যালিসিয়ার সাথে আগে কথা বলবো। তাকে দিয়ে স্বীকার করাবো যে গ্যাব্রিয়েলের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আমার সাথে মিথ্যে বলেছে। যেমনটা প্রফেসর ডায়োমেডেস বলেছিলেন, সত্যের মুখোমুখি হতে বাধ্য করবো তাকে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই সুযোগটা আর হলো না।
রিসিপশনের আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল ইউরি। “থিও, তোমার সাথে কথা আছে আমার।”
“কি হয়েছে?”
তার দিকে ভালো করে তাকাতেই চমকে যাই। রাতারাতি যেন বয়স বেড়ে গেছে লাটভিয়ান লোকটার! চেহারা একদম ফ্যাকাসে। খারাপ কিছু একটা ঘটেছে নিশ্চয়ই।
“একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। অ্যালিসিয়া…মানে ড্রাগ ওভারডোজ-”
“কি? ও ঠিক আছে তো?”
মাথা ঝাঁকালে ইউরি। “এখনও বেঁচে আছে, কিন্তু-”
“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ
“কিন্তু কোমায়। পরিস্থিতি একদমই ভালো না।”
“কোথায় এখন?”
গোলকধাঁধার মত করিডোরগুলো পেরিয়ে আমাকে আইসিইউতে নিয়ে এলো ইউরি। একটা প্রাইভেট রুমে রাখা হয়েছে অ্যালিসিয়াকে। ইসিজি মেশিন আর ভেন্টিলেটরের মৃদু গুঞ্জন কানে আসছে। চোখ দুটো বন্ধ, দেখে মনে হচ্ছে ঘুমোচ্ছে।
আরেকজন ডাক্তারের সাথে সেখানে আগে থেকেই ছিল ক্রিস্টিয়ান। রুমে উপস্থিত জরুরি বিভাগের ডাক্তারটার চাইতে অনেক বেশি ফ্যাকাসে লাগছে তাকে। অবশ্য ডাক্তার নিশ্চয়ই গ্রীষ্মমন্ডলীয় কোথাও ছুটি কাটিয়ে এসেছে, সেকারণেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তামাটে দেখাচ্ছে তার ত্বক। তবে মহিলার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ একদম স্পষ্ট।
“অ্যালিসিয়া কেমন আছে?” জিজ্ঞেস করলাম।
মাথা ঝাঁকালো ডাক্তার। “খুব একটা ভালো না। রোগির শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হলে আমরা বার্বিটুরেট ড্রাগ দিয়ে ইচ্ছেকৃতভাবে কোমায় নিয়ে যাই। ওর বেলায় সেটা করতেই অনেক বেগ পেতে হয়েছে। নিজে থেকে শ্বাস নিতে পারছে না একদমই।”
“কী খেয়েছিল?”
“ওপিওয়িড জাতীয় কোন পেইনকিলার। খুব সম্ভবত হাইড্রোকোড়ন।”
মাথা নাড়লো ইউরি। “ওর ঘরে ওষুধের খালি শিশি পাওয়া গেছে।”
“কে খুঁজে পায় ওকে?”
“আমি,” ইউরি বলল। “বিছানার পাশে মেঝেতে পড়ে ছিল। শ্বাস নিচ্ছিল না। প্রথমে তো ভেবেছিলাম মারাই গিয়েছে।”
“ওষুধগুলো কিভাবে পেলো জানো কিছু?”
ইউরি ক্রিস্টিয়ানের দিকে তাকালে জবাবে কাঁধ ঝাঁকায় সে। “ওয়ার্ডে অনেকেই টাকার বিনিময়ে এসব পিল এনে দেয়।”
“যেমন এলিফ,” আমি বললাম।
মাথা নেড়ে সায় দিল ক্রিস্টিয়ান। “আমারো ওকেই সন্দেহ হয়।”
এসময় ইন্দিরা উপস্থিত হলো আইসিইউতে। দেখে মনে হচ্ছে যেকোন সময় কান্না জুড়ে দিবে। “অন্যান্য রোগিরাও খুব বাজেভাবে প্রভাবিত হবে এই ঘটনার দ্বারা,” বলে একটা চেয়ারে বসে অ্যালিসিয়ার হাতে হাত রাখলেন তিনি। ভেন্টিলেটরের ওঠানামার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। বড় ঘরটা জুড়ে থকথক করছে নীরবতা।
“সব দোষ আমার,” কিছুক্ষণ পর বললাম।
মাথা ঝাঁকালেন ইন্দিরা। “তোমার কোন দোষ নেই থিও।”
“আমার উচিৎ ছিল ঠিকভাবে ওর খেয়াল রাখা।”
“তুমি তোমার সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছে। আমাদের চেয়ে অন্তত অনেক বেশি।”
“ডায়োমেডেসকে কেউ জানিয়েছে?”
মাথা ঝাঁকানো ক্রিস্টিয়ান। “তার সাথে এখনও কথা হয়নি।”
“মোবাইলে ফোন করেছিলে?”
“হ্যাঁ, বাসার নম্বরেও যোগাযোগ করেছিলাম। লাভ হয়নি।”
ভ্রূ কুঁচকে ফেললো ইউরি। কিন্তু আমি তো প্রফেসর ডায়োমেডেসকে দেখেছি। গ্রোভেই ছিলেন তিনি।”
“তাই?”
“হ্যাঁ, বেশ কিছুক্ষণ আগে অবশ্য। করিডোরের অন্য পাশে ছিলেন, দেখে মনে হচ্ছিল তাড়াহুড়োর মধ্যে আছেন।”
“অদ্ভুত তো। যাইহোক, হয়তো বাসায় গিয়েছেন। আবার ফোন দিও।”
মাথা নাড়লো ইউরি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে অন্য কোন ভাবনায় ডুবে আছে। অ্যালিসিয়ার এই কীর্তিতে সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছে সে-ই। খারাপই লাগলো বেচারার জন্যে।
ঠিক এই সময় ক্রিস্টিয়ানের পেজার বেজে উঠলে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায় সে। ইউরি আর ডাক্তারও চলে গেল রুম থেকে।
“অ্যালিসিয়ার সাথে কিছুক্ষণ একা থাকতে চাও?” দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো ইন্দিরা।