“তুমি অ্যালিসিয়াকে খাটো করে দেখো না। পুরোটাই তার ভয়ানক একটা চাল।” মাথা ঝাঁকিয়ে ধূসর আকাশের দিকে তাকালেন ডায়োমেডেস। “অ্যালিসিয়াকে দেখে মনে হতে পারে যে পরিস্থিতির শিকার, অসহায় এক নারী। কারো উচিৎ তার খেয়াল রাখা বা তাকে রক্ষা করা। নিজেকে ভিক্টিম আর ঐ মুখোশধারী আততায়ীকে ভিলেন সাজিয়েছে সে। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে অ্যালিসিয়া আর ঐ ব্যক্তি একই সত্ত্বা। সে-ই মেরেছে গ্যাব্রিয়েলকে। কিন্তু নিজের কাছে দোষ স্বীকার করতে চাইছে না। তাই এই গল্পটা ফেঁদেছে। এখানে অ্যালিসিয়া নিরপরাধ ভিক্টিম আর তুমি তার ত্রাণকর্তা। আর তুমিও যেহেতু ব্যাপারটার সাথে জড়িয়ে গেছে, ওর প্রভাবে সব দায়িত্বও ভুলতে বসেছে।”
“মাফ করবেন, আমি আপনার সাথে একমত নই। তাছাড়া সে মিথ্যে বলছে বলেও আমার মনে হচ্ছে না। অন্তত সচেতনভাবে তো নয়ই। গল্পটা আর কেউ না হলেও সে নিজে পুরোপুরি বিশ্বাস করে।”
“হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছ। তবে অ্যালিসিয়ার বিপদের কারণ সে নিজেই-বাইরের কেউ নয়।”
আমি জানি যে ভুল বলছেন প্রফেসর, কিন্তু এ বিষয়ে তর্ক করে আর লাভ নেই। হাতের সিগারেটটা নিভিয়ে ফেললাম।
“এখন কি করা উচিৎ আমার?”
“অ্যালিসিয়াকে সত্যের মুখোমুখি হতে বাধ্য করো। তাহলেই কেবল তার সুস্থ হবার একটা সম্ভাবনা থাকবে। গল্পটা যে বিশ্বাস করোনি, এটা একদম পরিস্কার করে বলবে তাকে। অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরে, সত্যটা দাবি করো।”
“আপনার কি মনে হয়? বলবে সে?”
“সেটা-” কাঁধ নাচালেন প্রফেসর। লম্বা একটা টান দিলেন চুরুটে। “এ মুহূর্তে কেউ বলতে পারবে না।”
“ঠিক আছে। কালকে তার সাথে আবারো কথা বলবো আমি। সত্যটা বের করার চেষ্টা করবো।”
ক্ষণিকের জন্যে অস্বস্তি ভর করলো ডায়োমেডেসের চেহারায়। কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেও শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলালেন। চুরুটটা দেয়ালে পিষে মাটিতে ফেলে দিলেন আলাপের ইতি টানার ভঙ্গিতে। “কালকেই কিন্তু।”
.
৪.১৬
কাজ শেষে বাসায় ফিরে আবারো ক্যাথির পিছু নেই। ঠিক আগের দিনের মতোই পার্কে একই জায়গায় অপেক্ষা করছিল তার প্রেমিক। সদ্য প্রেমে পড়া তরুণ-তরুণীদের মত একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো দুজনে।
আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেদিকটায় তাকালো ক্যাথি। এক মুহূর্তের জন্যে ভেবেছিলাম ধরা পড়ে গেছি বুঝি। কিন্তু না, অন্য কোনদিকে মনোযাগ দেয়ার সময়ই নেই তার। এবারে লোকটার চেহারা ভালো করে দেখার চেষ্টা করি, কিন্তু লাভ হয় না। তবে তার শারীরিক গঠন কেন যেন পরিচিত ঠেকছিল। কোথাও হয়তো দেখেছি আগে।
ক্যামডেনের দিকে এগিয়ে কিছুক্ষণ পর একটা পাবে ঢুকে পড়লো ওরা। দ্য রোজ ক্রাউন। পরকীয়ার জন্যে একদম আদর্শ একটা জায়গা। আমি বিপরীত দিকে ক্যাফেটায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একঘন্টা পর বেরিয়ে এলো দুজনে। ক্যাথি পারলে লোকটার কোলে উঠে যায়। রাস্তায় দাঁড়িয়েই দীর্ঘ চুম্বনে আবদ্ধ হলো দুজনে। দৃশ্যটা দেখে পেটের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো। ঘৃণা এতটা তীব্র হতে পারে জানা ছিল না।
একসময় অনিচ্ছাসত্ত্বেও লোকটা বিদায় জানায় ক্যাথি। বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করে। লোকটা রওনা দেয় বিপরীত দিকে। তবে আজকে আর ক্যাথির পিছু নিলাম না।
আজ লোকটাকে অনুসরণ করবে বলে ঠিক করেছি।
বাস স্টপে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো সে। আমি তার ঠিক পেছনেই আছি। ইচ্ছে করছে ধাক্কা দিয়ে চলন্ত বাসের সামনে ফেলে দেই। কিন্তু সেরকম কিছু করলাম না। সে বাসে উঠে পড়লে আমিও তা-ই করলাম।
ভেবেছিলাম এই বাসেই সরাসরি বাড়ি ফিরবে সে হয়তো। কিন্তু না, কয়েকবার বাস পাল্টালো লোকটা। কিছুটা দূর থেকে তাকে অনুসরণ করে চলেছি আমি। কিছুক্ষণ পর ইস্ট এন্ডে চলে আসে সে। একটা ওয়্যারহাউজে ঢুকে প্রায় আধাঘন্টা কাটিয়ে দেয়। এরপর আবারো বাসস্টপে গিয়ে একটা বাসে উঠে পড়ে। এসময় কয়েকটা ফোন করে সে। নিচু গলায় কথা বলছিল গোটা সময়, তবে হাসির শব্দটা ঠিকই শুনতে পাই। কে জানে, হয়তো ক্যাথির সাথে কথা বলছে। ভেতরে ভেতরে হতাশা আর ক্রোধ দলা পাকিয়ে উঠছে। তবুও হাল ছাড়তে রাজি নই, এতটাই গোঁয়ার আমি।
এক পর্যায়ে বাসার পথ ধরলো সে। বাস থেকে নেমে নির্জন একটা রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলো। এখনও কানে ফোন চেপে রেখেছে। আশপাশে কোথাও কেউ নেই। যদি এ মুহূর্তে পিছে ফেরে সে, তাহলে আমাকে দেখে ফেলবে। কিন্তু ওরকম কিছু করলো না।এখন যে বাড়িটার সামনে দিয়ে এগোচ্ছি তার উঠোনে বিশাল বাগান, সেখানে শোভা পাচ্ছে বেশ কয়েক জাতের জেইড প্ল্যান্ট।
আমার নিজের শরীরের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই এ মুহূর্তে, মনে হচ্ছে যে আপনা আপনিই চলছে। হাত বাড়িয়ে বাগান থেকে একটা পাথর তুলে নিলাম। বেশ ভারি। আমার হাতগুলো ঠিকই জানে, কী করতে হবে। পাথরটা দিয়ে মাথায় জোরে একবার আঘাত করলেই হারামজাদার যাবতীয় নষ্টামি ছুটে যাবে। আরো কাছে এগিয়ে গেলাম সন্তর্পণে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আজকেই ফয়সালা হয়ে যাবে। সে যদি ফোনে কথা না বলতে তাহলে আমার উপস্থিতি টের পেয়ে যেত এতক্ষণে। আর দেরি করা যাবে না।
সর্বশক্তিতে পাথরটা দিয়ে লোকটার মাথায় আঘাত করতে উদ্যত হয়েছি, ঠিক এমন সময় বাম দিকের বাসাটার দরজা খোলার শব্দ কানে এলো। বেশ কয়েকবার ‘ধন্যবাদ’, ‘বাসায় আসবেন’-কথাগুলো শুনতে পেলাম। দ্রুত পাশে সরে এসে আড়ালে লুকিয়ে পড়ি। এক মুহূর্তের জন্যে জমে গিয়েছিলাম ওখানেই। ক্যাথির প্রেমিক বাড়িটার দিকে তাকালো, তবে আমাকে দেখেনি।