“আমি কিছুক্ষণ পরে আসি বরং?”
মাথা ঝাঁকিয়ে মানা করে দিলেন ডায়েমেডেস। জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে রাখলেন টেবিলের ওপরে। “আর ঘুম আসবে না আমার। বলো। তাহলে কি হয়েছে?”
“অ্যালিসিয়ার সাথে কথা বলছিলাম আমি…আপনার পরামর্শ প্রয়োজন।”
মাথা নাড়লেন ডায়োমেডেস। আসলে তা কেটে যাচ্ছে তার। এখন চোখে ভর করেছে আগ্রহ। “কী রকম পরামর্শ?”
হাতের কাগজগুলো থেকে সবকিছু তাকে পড়ে শোনালাম। অ্যালিসিয়া আমাকে যেভাবে কথাগুলো বলেছে, আমিও ঠিক সেভাবেই বলার চেষ্টা করেছি। প্রফেসর শুনলেন, কী করে একজন আততায়ী অ্যালিসিয়াদের বাসায় ঢুকে গ্যাব্রিয়েলকে খুন করে তার চোখের সামনে।
আমার কথা বলা শেষ হলে লম্বা একটা সময় চুপ করে থাকলেন। ডায়োমেডেস। তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে না মগজে কী চলছে। ডেস্ক থেকে একটা চুরুট বের করে ছোট রূপালী গিলোটিনের সাহায্যে সেটার মাথা কেটে নিলেন সাবধানে।
“কাউন্টারট্রান্সফিয়ারেন্স থেকেই শুরু করি তাহলে। তোমার নিজের অনুভূতি সম্পর্কে বলল, একদম প্রথম থেকে। অ্যালিসিয়া যখন গল্পটা বলছিল, কেমন লাগছিল তোমার?”
কিছুক্ষণ ভাবলাম। প্রথম দিকে বেশ উত্তেজিত ছিলাম….আর কিছুটা উদ্বিগ্ন। ভীত।”
“ভীত? ভয়টা কি তোমার নিজের, নাকি অ্যালিসিয়ার?”
“দু’জনেরই বোধহয়।”
“কেন ভয় পাচ্ছিলে?”
“সেব্যাপারে নিশ্চিত নই। হয়তো ব্যর্থ হবো, এই ভয় কাজ করছিল। অনেক কিছুই নির্ভর করে আছে এর ওপরে।”
মাথা নাড়লেন ডায়োমেডেস। “আর কিছু?”
“খুব হতাশও লাগছিল। আসলে অ্যালিসিয়ার সাথে সেশনগুলোয় প্রায়ই এই অনুভূতিটা হয়েছে।”
“রাগ হয়নি কখনো?”
“হ্যাঁ, হয়েছে।”
“অবাধ্য সন্তানকে কথা শোনাতে না পারলে বাবাদের যেরকম লাগে, তোমারও ওরকমই লাগছিল?”
“হ্যাঁ, অ্যালিসিয়াকে সাহায্য করতে চাইছিলাম আমি। কিন্তু সে সাহায্য পেতে ইচ্ছুক কি না তা বলতে পারবো না।”
আবারো মাথা নাড়লেন ডায়োমেডেস। “আপাতত তাহলে আমরা রাগ নিয়ে কথা বলি। এই রাগটা ফুটে ওঠে কি করে?”
দ্বিধা ভর করলো আমার চিত্তে। “বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেশন চলাকালীন সময়ে প্রচণ্ড মাথাব্যথা থাকে আমার।”
“এইতো! এক না এক উপায়ে রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটবেই। গ্রুপ থেরাপি বিষয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে, জানো? সাধারণত ট্রেইনিরা গ্রুপ থেরাপি সেশন পরিচালনা করে। যাইহোক, এম মিল্টন তার গ্রুপ থেরাপি বিষয়ক গবেষণাপত্রের শুরুতে লিখেছিলেন যে ট্রেইনি থেরাপি সেশনের সময় উদ্বিগ্ন হবে না, সে অসুস্থ হয়ে পড়বে। “
“এরকম কিছু শুনিনি,” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম। “আমি একইসাথে অসুস্থ এবং উদ্বিগ্ন হতাম।”
হাসলেন ডায়োমেডেস। “তুমি তো আর ট্রেইনিনও। যদিও প্রশিক্ষণের সময়কার অনুভূতিগুলো কখনোই ভোলা যায় না।” চুরুটটা তুলে নিলেন তিনি। “চলো বাইরে যাই।”
***
জরুরি বহির্গমন সিঁড়ির কাছে চলে আসি আমরা। চুরুটে টান দেয়ার পাশাপাশি আমার বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবছেন ডায়োমেডেস। কিছুক্ষণ পর একটা উপসংহারে পৌঁছে গেলেন।
“ও মিথ্যে বলছে, তা বোধহয় বুঝতেই পারছো তুমি।”
“মানে গ্যাব্রিয়েলের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সে যা বলেছে? হ্যাঁ, আমারো সেটাই মনে হচ্ছে।”
“না, শুধুমাত্র হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারেই নয়।”
“তাহলে?”
“পুরোটাই একটা গাঁজাখুরি গল্প। একটা শব্দও বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।”
আমি যে প্রচণ্ড অবাক হয়েছি, তা নিশ্চয়ই আমার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল। ভেবেছিলাম অ্যালিসিয়ার গল্পের কিছু বিষয়ে হয়তো সন্দেহ পোষণ করবেন প্রফেসর। কিন্তু পুরাটাকেই যে বাতিল করে দেবেন, এটা ভাবিনি।”
“লোকটার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না আপনি?”
“না, করি না। আমার ধারণা এই ‘মুখোশধারী আততায়ী’-র ব্যাপারটা অ্যালিসিয়ার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা বৈ কিছু নয়।”
“এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে?”
একটা অদ্ভুত হাসি ফুটলো ডায়োমেডেসের চেহারায়। “এটা আমার আন্দাজ বলতে পারে, আবার এত বছরের পেশাদারী অভিজ্ঞতাও বলতে পারো।”আমি দ্বিমত পোষণ করে কিছু বলার আগেই হাত উঁচিয়ে আমাকে থামালেন তিনি। “আমি কিন্তু এমনটা আশা করছি না যে তুমি আমার সাথে একমত হবে, থিও। অ্যালিসিয়াকে নিয়ে যে কারো চেয়ে অনেক বেশি ভেবেছো তুমি। তাই তার অনুভূতিগুলোর সাথে তোমার অনুভূতিগুলোও জট পাকিয়ে গেছে। সুপারভাইজার হিসেবে আমার কাজ হচ্ছে সেগুলো আলাদা করতে তোমাকে সাহায্য করা। আর একবার যদি অ্যালিসিয়া সম্পর্কে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে পারো, তাহলে দেখবে তার সম্পর্কে তোমার ধারণাই বদলে গেছে।”
“আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না।”
“সোজাসুজি বললে, আমার ধারণা শুরু থেকেই তোমার সামনে অভিনয় করছে সে। তোমাকে দিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধির চেষ্টা করছে। অন্যকে সাহায্য করার তোমার যে স্বভাবজাত গুণ, সেটার ফায়দা লুটতে চেয়েছে আর কি। আমি শুরু থেকেই বুঝেছিলাম যে ওকে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করাই তোমার লক্ষ্য। অ্যালিসিয়ারও নজর এড়ায়নি সেটা। সেজন্যে তোমার জন্যে ফাঁদ পেতেছে। প্রেমের ফাঁদও বলা যায়।”
“ক্রিস্টিয়ানের মত শোনাচ্ছে আপনার কথাগুলো। আমাকে কোন প্রেমের ফাঁদে ফেলেনি অ্যালিসিয়া। তাছাড়া রোগিদের কারো ভিন্ন কোন উদ্দেশ্যে আছে কি না, তা বোঝার মত বুদ্ধিমত্তা রাখি আমি। দয়া করে আমাকে খাটো করে দেখবেন না, প্রফেসর।”