“এরপর? গ্যাব্রিয়েল কি বলে?”
“বলে যে…ফটো শ্যুটটায় ঝামেলা হয়েছে, বাসায় ফিরতে আরো দেরি হবে। আমি যেন খেয়ে নেই। কমসেকম দশটা বেজে যাবে তার কাজ শেষ হতে। ফোন কেটে দিয়ে বলি ‘গ্যাব্রিয়েল কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে। এর আগেই আপনি চলে যান। হাসে লোকটা। কিন্তু আমি তো শুনলাম দশটার আগে ফিরবে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে তাহলে। দড়ি নিয়ে আসুন, টেপ হলেও চলবে। আপনাকে বেঁধে ফেলি।
“সে যা বলে তা-ই করি আমি। জানতাম যে আর কোন উপায় ছিল না। পুরোপুরি আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম।”
কথা বলা বন্ধ করে আমার দিকে তাকায় অ্যালিসিয়া। একসাথে অনেকগুলো আবেগ খেলা করছে তার দৃষ্টিতে। আসলেও বোধহয় আজকে একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে।
“আমাদের কিছুক্ষণের বিরতি নেয়া উচিৎ এখন।”
“না, কথা শেষ করতে হবে আমাকে। করতেই হবে।”
আগের চেয়ে দ্রুত কথা বলছে সে এখন। “বাসায় কোন দড়ি ছিল না, তাই ক্যানভাস ঝোলানোর তার দিয়ে কাজ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় লোকটা। আমাকে লিভিং রুম নিয়ে যায়। এরপর ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে বসিয়ে বাঁধতে শুরু করে। টের পাচ্ছিলাম, চামড়া কেটে বসে যাচ্ছে তার। ‘প্লিজ, অনুনয় করি আমি। প্লিজ’ কিন্তু শোনেনা সে। হাতদুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে। আমি তখন পর্যন্ত নিশ্চিত ছিলাম, আমাকে মেরেই ফেলবে সে। আসলে…আসলে তখন আমাকে খুন করলেই ভালো হতো।”
তীব্র আক্রোশের সাথে কথাগুলো বলে সে। হঠাৎ আবেগের এই চরম বহিঃপ্রকাশে অবাক না হয়ে পারি না।
“এটা কেন বললেন?”
“কারণ পরবর্তিতে সে যা করে, তার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো ছিল।”
এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো কেঁদেই ফেলবে অ্যালিসিয়া। তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়া থেকে নিজেকে থামাতে বেশ কষ্ট হলো আমার। ইচ্ছে করছিল তার কপালে চুমু খেয়ে বলি যে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করলাম নিজেকে। দেয়ালের সাথে চেপে ধরে সিগারেটটা নিভিয়ে ফেললাম।
“কারো উচিৎ আপনার যত্ন নেয়া, খেয়াল রাখা। আমার নিজেরই আপনার খেয়াল রাখতে ইচ্ছে করছে, অ্যালিসিয়া।”
“না,” দৃঢ়ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো সে। “আপনার কাছ থেকে এসব চাই না আমি।”
“তাহলে কি চান?”
জবাব দিলনা অ্যালিসিয়া। বরং উল্টোদিকে ঘরে ভেতরের যাওয়ার দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
.
৪.১৪
থেরাপি রুমের বাতি জ্বেলে দরজা লাগিয়ে দিলাম। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি অ্যালিসিয়া ইতোমধ্যেই বসে পড়েছে। তবে নিজের চেয়ারে নয়, আমার চেয়ারে বসেছে সে।
অন্যসময় হলে তার এই আচরণের পেছনে নিগঢ় কোন কারণ খোঁজার চেষ্টা করতাম, কিন্তু এবারে কিছুই বললাম না। আমার চেয়ারে বসে যদি সে নিজের কর্তৃত্ব জাহির করতে চায়…করতে পারে। আপাতত আমি গল্পের শেষটুকু শোনার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছি। তাই চুপচাপ তার বিপরীত দিকে বসে পড়লাম।
কিছুক্ষণ একদম স্থির বসে থাকার পর মুখ খুলল সে। “আমাকে চেয়ারে একদম শক্ত করে বাঁধে লোকটা। একটু নড়াচড়া করলেই তারগুলো চামড়া কেটে আরো গভীরে বসে যাচ্ছিল, এক পর্যায়ে রক্ত ঝরতে শুরু করে। তবে সেটা একদিক ভালোই হয়েছিল, ক্ষতস্থানগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কারণে মনের উল্টোপাল্টা ভাবনাগুলো দূরে রাখতে পারছিলাম। সেগুলো অনেক বেশি ভীতিকর ছিল। ভাবছিলাম গ্যাব্রিয়েলকে আর দেখতে পাবোনা কখনো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হবে আমার।”
“এরপর কি হলো?”
“ওখানেই ঠাই বসে থাকি আমরা। মজার ব্যাপার কি জানেন? এর আগে আমি সবসময় ভাবতাম যে ভয় পেলে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কিন্তু ধারণাটা ভুল ছিল। খুব বেশি গরম লাগছিল তখন, যেন পুরো শরীরে আগুন ধরে গেছে। দরজা জানালা সব বন্ধ ছিল অবশ্য। তবুও, একদম ভ্যাপসা গরম ছিল ভেতরে। কপাল থেকে ঘাম চুঁইয়ে পড়ার কারনে চোখ জলছিল। লোকটার শরীর থেকে ঘাম আর মদের গন্ধ পাচ্ছিলাম। পুরোটা সময় কথা বলে যায় সে, আমি ভালো করে মনোযোগ দিয়ে শুনিনি। একটা বড় মাছির শব্দ কানে আসে। বাইরে বের হবার চেষ্টা করছিল সেটা, বারবার তো খাচ্ছিল জানালার কাঁচে। গ্যাব্রিয়েলের ব্যাপারে আমাকে অনেক প্রশ্ন করে লোকটা। কিভাবে আমাদের দেখা হয়েছিল, কতদিন ধরে একসাথে আছি, সংসারে সুখি কি না–এসব। তখন আমার মনে হয় যে কথা বলে সময় নষ্ট করলে বুঝি আমার বাঁচার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। তাই তার প্রশ্নগুলোর জবাব দেয়া শুরু করি। গ্যাব্রিয়েল, আমার কাজ-সবকিছু নিয়ে কথা বলি। কিছু সময়ের খুব দরকার ছিল আমার। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম। এভাবেই একসময় খেয়াল করি, দশটা বেজে গেছে…এরপর সাড়ে দশটা। কিন্তু গ্যাব্রিয়েলের বাসায় ফেরার নাম নেই।
“দেরি হয়ে গেছে, লোকটা বলে। আজকে বোধহয় আর আসবে না।”
“আসবে ও, “ আমি জবাব দেই।
“আমি থাকাতে আপনার সুবিধেই হয়েছে, কি বলেন? “
“ঠিক এগারোটার সময় বাইরে থেকে একটা গাড়ির শব্দ শুনতে পাই। জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দেয় লোকটা। একদম ঠিক সময়েই এসেছে, বলে সে।
***
অ্যালিসিয়ার ভাষ্যমতে এরপরের ঘটনাগুলো অনেক দ্রুত ঘটে।
লোকটা অ্যালিসিয়ার চেয়ারটা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয় যাতে দরজা থেকে তার চেহারা না দেখা যায়। বলে যে সে যদি টু শব্দটিও করে, তাহলে গ্যাব্রিয়েলের খুলি উড়িয়ে দিবে। এরপর গা ঢাকা দেয়। সবগুলো বাতি নিভে যায় কিছুক্ষণ পর। চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। হলওয়ে থেকে দরজা খোলা-বন্ধের শব্দ ভেসে আসে।