সেজন্যেই বোধহয় ক্রিস্টিয়ান সবসময় তাকে ওষুধ দিয়ে প্রায় বেহুঁশ করে রাখতো। ও কি অ্যালিসিয়াকে ভয় পায়? সত্যি বলতে আমি নিজেও কিছুটা ভয় পাই। আসলে ঠিক ভয় না, বরং বলা যায় যে অতিরিক্ত সতর্ক থাকি তার আশেপাশে। যা-ই করি সাবধানে, ভেবেচিন্তে করতে হবে।
“মানা হবে কেন?” বললাম। “আমিও ধরাচ্ছি একটা আপনার সাথে।”
সিগারেট মুখে দিয়ে জ্বালোম। এরপর নীরবে কিছুক্ষণ ধোঁয়া ছাড়ি আমরা, একে অন্যের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে। অ্যালিসিয়া আর আমার মাঝের দূরত্ব বিপজ্জনক রকমের কম, শেষমেশ চোখ ঘুরিয়ে নিতে বাধ্য হলাম। কেমন জানি লজ্জা লাগছিল।
“আমরা হাঁটি নাহয়?”
“ঠিক আছে,” মাথা নেড়ে বলল অ্যালিসিয়া।
চত্বরের সীমানা ঘেঁষে হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। অন্যান্য রোগিরা তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। তারা কি ভাবছে কে জানে, তবে অ্যালিসিয়াকে সেসব নিয়ে বিচলিত মনে হলো না। এমনকি তাদের দিকে একবারের জন্যে তাকায়ওনি সে। নীরবেই কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম।
“এরপর কি ঘটেছিল শুনবেন না?” এক সময় জিজ্ঞেস করলো অ্যালিসিয়া।
“আপনি প্রস্তুত? আমার কোন সমস্যা নেই।”
আবারো মাথা নাড়ে অ্যালিসিয়া। “হা প্রস্তুত।”
“লোকটা তাহলে আপনাকে বাসার ভেতরে নিয়ে দরজা আটকে দেয়। এরপর?”
“লোকটা ড্রিঙ্কসের কথা বলে। তাই তাকে গ্যাব্রিয়েলের একটা বিয়ারের ক্যান দেই আমি। আমি নিজে বিয়ার খাই না। আর বাসায় ঐ সময় অন্য কিছু ছিল না।”
“এরপর?”
“কিছু একটা নিয়ে কথা বলে লোকটা।”
“কি নিয়ে?”
“মনে নেই আমার।”
“কিছুই মনে নেই?”
“না”
আবারো চুপ হয়ে গেল সে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর যখন দেখলাম মুখ খুলছে না, তাগাদা দিলাম। “ঠিক আছে। আপনারা রান্নাঘরে ছিলেন তখন। কেমন বোধ হচ্ছিল?”
“আসলে…আসলে কোন বোধজ্ঞানই ছিল না তখন আমার।”
মাথা নাড়লাম। “ওরকম পরিস্থিতিতে এটাই স্বাভাবিক। বিপদে পড়লে আমাদের অনুভূতি একদম ভোতা হয়ে যায়। পালাবো নাকি পালাবো না এটা ভাবতে ভাবতে জমে যাই একদম।”
“আমি জমে যাইনি।”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ,” তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে অ্যালিসিয়া। “আসলে নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম। মনে মনে ছক কষছিলাম কিভাবে পাল্টা আঘাত হানা যায়। লোকটাকে খুনের ফন্দি আঁটছিলাম।”
“আচ্ছা। খুনটা কিভাবে করতেন আপনি?”
“গ্যাব্রিয়েলের বন্দুকটা দিয়ে। ওটা কিভাবে নাগালে পাওয়া যায় সেটা ভাবছিলাম।”
“বন্দুকটা তো বোধহয় আপনি রান্নাঘরে এনে রেখেছিলেন? ডায়েরিতে সেটাই লেখা।”
মাথা নাড়লো অ্যালিসিয়া। “হ্যাঁ, জানালার পাশের থালা-বাসন রাখার কাবার্ডে।” এই পর্যায়ে সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে ধোয়া ছাড়লো অ্যালিসিয়া। “লোকটাকে বলি যে পানি খাবো। গ্লাস আনতে যায় সে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই কাবার্ডের দিকে। মনে হচ্ছিল ওটুকু এগোতেও খুব। বেশি সময় লাগছে। কাঁপা কাঁপা হাতে কাবার্ডের পাল্লা খুলি…”
“আর?”
“খালি ছিল ভেতরটা। বন্দুকটা কেউ সরিয়ে ফেলেছিল। এসময় পেছন থেকে লোকটা বলে-গ্লাসগুলো আপনার ডানপাশের কাবার্ডে। ঘরে তাকিয়ে দেখি বন্দুকটা তার হাতে। ওটা আমার দিকে তাক করে হাসছিল সে।”
“তখন?”
“কি তখন?”
“আপনার মাথায় কি চলছিল?”
“এটাই যে শেষ সুযোগটাও হারিয়ে ফেলেছি আমি-আমাকে মেরে ফেলবে লোকটা।”
“আপনার মনে হচ্ছিল, লোকটা আপনাকে মেরে ফেলবে?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে দেরি করলো কেন সে? বাড়ির ভেতরে ঢোকার পরেই তো কাজটা করতে পারতো।”
জবাব দিল না অ্যালিসিয়া। তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। হাসছে সে।
“লিডিয়া ফুপির একটা বাদামি রঙের বিড়াল ছিল। অনেক আগের কথা এটা। বিড়ালটাকে একদমই পছন্দ ছিল না আমার। প্রায়ই খামচে রক্ত বের করে ফেলতো। দয়ামায়া বলে কিছু ছিল না।”
“পশুপাখিদের ক্ষেত্রে তো দয়ামায়া কথাটা ঠিক খাটেনা। তারা যা করে, আত্মরক্ষার খাতিরেই করে।”
তন্ময় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় অ্যালিসিয়া। “ভুল কথা। অনেক পশুপাখিই নিষ্ঠুর ধরণের। অন্তত ঐ বিড়ালটার ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য। বাইরে থেকে প্রায়ই আহত পাখি বা ছোট জীব-জন্তু নিয়ে আসতো। সবগুলোই আধ-মরা। আহত, কিন্তু মারা যায়নি। ওগুলো নিয়ে খেলতো।”
“আচ্ছা। আপনি কি বলতে চাইছেন যে লোকটাও আপনাকে নিয়ে অনেকটা ওরকমই করছিল? তার জন্যে বিকৃত একটা খেলা ছিল ব্যাপারটা?”
সিগারেটটা শেষ করে মাটিতে ফেলে দিল অ্যালিসিয়া। এরপর আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “আরেকটা দিন।”
তার দিকে প্যাকেটটা এগিয়ে দিলাম। এবারে নিজেই সিগারেট জ্বাললো সে। কিছুক্ষণ চুপচাপ ধোয়া ফোকার পর বলল, “গ্যাব্রিয়েলের আটটার দিকে বাসায় ফেরার কথা ছিল। আর তখন বাজছিল ছয়টা। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম আমি। কি ব্যাপার? লোকটা বলে। ‘আমার সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগছে না আপনার বন্দুকের নলটা আমার শরীরে স্পর্শ করে সে। দৃশ্যটা কল্পনা করে কেঁপে উঠলো অ্যালিসিয়া। “আমি বলি গ্যাব্রিয়েল যে কোন মুহূর্তে এসে পড়বে। এসে কি করবে? আপনাকে উদ্ধার করবে? লোকটা জিজ্ঞেস করে।”
“জবাবে আপনি কি বলেছিলেন?”
“কিছু না। শুধু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলাম…এসময় আমার ফোনটা বেজে ওঠে। গ্যাব্রিয়েল কল দিয়েছিল। লোকটা বলে ফোন ধরতে। বন্দুকটা আমার কপাল বরাবর তাক করে রেখেছিল।”