প্রশ্নটা শুনে দৃশ্যতই হতাশ মনে হলো অ্যালিসিয়াকে। জানালার দিকে মুখ ফেরালো সে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম দু’জন। উত্তর জানার জন্যে ভেতরে ভেতরে অধীর হয়ে উঠলেও, নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। তাহলে কি অ্যালিসিয়ার কথা বলাটা সাময়িক ছিল? এখন আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে সে? তা হতে দিতে পারি না আমি।
“অ্যালিসিয়া, আমি জানি ব্যাপারটা আপনার জন্যে কষ্টের। কিন্তু একবার যদি আমার সাথে এ বিষয়ে কথা বলা শুরু করেন, তাহলে দেখবেন অনেকটাই সহজ লাগছে, সত্যি।”
কোন উত্তর নেই।
“চেষ্টা করুন। প্লিজ। এতটা পথ পাড়ি দেয়ার পর হাল ছেড়ে দিবেন না। বলুন আমাকে…কেন কথা বলেননি এতদিন?”
শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল অ্যালিসিয়া। এরপর কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল :
“কিছু…কিছু বলার নেই।”
“মাফ করবেন, আপনার এই কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। বলার মত কিছু না কিছু অবশ্যই আছে।”
আবারো বিরতি। কাঁধ নাচালো অ্যালিসিয়া। “হয়তো। হয়তো…ঠিকই বলছেন আপনি।”
“বলুন তাহলে।”
দ্বিধা ফুটলো অ্যালিসিয়ার চেহারায়। “য-যখন গ্যাব্রিয়েল মারা যায়…প্রথমে…আ-আমি কথা বলার চেষ্টা করি…কিন্তু পারিনি। মুখ খুলেছিলাম, কিন্তু কোন শব্দ বের হয়নি। অনেকটা স্বপ্নের মত… যেখানে চেষ্টা করেও চিৎকার করতে পারি না আমরা…”
“আপনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন তখন। কিন্তু এর পরে তো কথা বলতে সমস্যা হবার কথা নয়, তাই না?”
“ততদিনে…অর্থহীন মনে হচ্ছিল সবকিছু। বড় দেরি হয়ে গিয়েছিল।”
“দেরি হয়ে গিয়েছিল? আত্মপক্ষ সমর্থনের কথা বলছেন?”
একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো অ্যালিসিয়া। তার মুখের হাসিটা দুর্বোধ্য ঠেকছে এখন। কোন কথা বলল না।
“আবারো কথা বলা শুরু করলেন কেন?”
“সেটার উত্তর তো আপনি জানেন।”
“আসলেই জানি কি?
“আপনার জন্যে।”
“আমি?” বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালাম তার দিকে।
“আপনি এখানে এসেছেন বলেই…”
“তাতে কি আসলেও পরিস্থিতির কোন রদবদল হয়েছে?”
“হয়েছে, আলবত হয়েছে।” পরবর্তী কথাগুলো নিচুস্বরে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল অ্যালিসিয়া। “আমি চাই আপনি বুঝুন, আমার সাথে কী হয়েছিল, কেমন লেগেছিল। আপনার বোঝাটা জরুরি।”
“আমি আসলেও বুঝতে চাই। সেজন্যেই তো ডায়েরিটা দিয়েছিলেন, তাই না? যাতে আমি বুঝতে পারি। আপনার কাছের মানুষগুলো সেই লোকটার ব্যাপারে আপনার কথা বিশ্বাস করেনি। আপনি বোধহয় নিশ্চিত হতে চাইছিলেন…আমি আপনাকে বিশ্বাস করি কি না।”
“আপনি বিশ্বাস করেন।” সূর্য পূর্বদিকে ওঠে, এই চিরন্তন সত্যটা সবাই যেভাবে বলে, সেভাবেই কথাটা বলল অ্যালিসিয়া।
মাথা নাড়লাম। “হ্যাঁ। আপনাকে বিশ্বাস করি আমি। তাহলে সেখান থেকেই শুরু করি নাহয়? ডায়েরির একদম শেষে লিখেছিলেন যে লোকটা আপনাদের বাসায় ঢুকে পড়েছে। এরপর কি হয়েছিল?”
“কিছু না।”
“কিছু না?”
মাথা ঝাঁকালো অ্যালিসিয়া। “ভুল ভেবেছিলাম আমি। অন্য একজন এসেছিল”
“কে?”
“জিন-ফিলিক্স। প্রদর্শনীর ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিল সে।”
“আপনার ডায়েরির লেখাগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে, তখন কারো সাথে কথা বলার মত অবস্থায় ছিলেন না আপনি।”
জবাবে কাঁধ ঝাঁকালো অ্যালিসিয়া।
“কতক্ষণ ছিল জিন-ফিলিক্স?”
“খুব বেশিক্ষণ না। ওকে চলে যেতে বলি আমি। কষ্ট পেয়েছিল, কিছুক্ষণ চিৎকার-চেঁচামেচিও করে। কিন্তু কথা শোনে।”
“এরপর? জিন-ফিলিক্স চলে যাবার পর কি হলো?”
“সে ব্যাপারে কথা বলতে চাইছিনা।”
“কিছুই বলবেন না?”
“আপাতত না।”
আমার চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারো জানালার দিকে মুখ ফেরায় অ্যালিসিয়া। অন্ধকার হয়ে আসা আকাশ দেখছে জানালার ফাঁক দিয়ে। মাথা কাত করে রাখার ভঙ্গিতে অনেকটা ছেলেমানুষী ভাব, ঠোঁটের কোণায় হাসির আভাস। আসলে আমাকে এভাবে কৌতূহলের মধ্যে রেখে মজা পাচ্ছে সে।
“তাহলে কি নিয়ে কথা বলতে চান?” জিজ্ঞেস করলাম।
“জানি না। শুধু কথা বলতে চাই।”
তাই আলাপ চালিয়ে গেলাম আমরা। লিডিয়া আর পলের ব্যাপারে কথা বললাম। অ্যালিসিয়ার মায়ের গল্প শুনলাম। আমাদের দুজনের শৈশব নিয়ে স্মৃতিচারণ করলাম। আমার অতীত নিয়ে খুবই কৌতূহলী মনে হলো অ্যালিসিয়াকে। বাবার ব্যাপারে সব বললাম, কিভাবে ভয়ের মধ্যে বড় হয়েছি, কিভাবে বাসা থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে এসেছি-এগুলোও বাদ দিলাম না। বোধহয় আজকের এই আমাকে অতীতে কোন বিষয়গুলো প্রভাবিত করেছে সেটা জানাটাই মূল উদ্দেশ্যে ছিল তার।
গোটা সময় আমি ভাবছিলাম যে আবারও শুরু থেকে সব আরম্ভ করার কোন সুযোগ নেই। একজন থেরাপিস্ট আর তার রোগির মধ্যে যে দেয়ালটা থাকে, সেটা আরো আগেই গুঁড়িয়ে গেছে।
এখন হয়তো অনেকেরই প্রশ্ন জাগতে পারে যে এখানে কে রোগি আর কে চিকিৎসক।
.
৪.১২
পরদিন সকালে আবারো দেখা করলাম অ্যালিসিয়ার সাথে। তবে আজকে একদম অন্যরকম লাগছে তাকে। গতকালের তুলনায় অনেক বেশি গম্ভীর আর সতর্ক। হয়তো গ্যাব্রিয়েলের মৃত্যুর ঘটনাটা নিয়ে কথা বলবে বলেই নিজেকে প্রস্তুত করছিল।
মুখোমুখি বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, সচরারচর কিন্তু এমনটা করে না। একবারের জন্যেও চোখ ফেরাচ্ছে না অন্যদিকে। নিজ থেকেই ধীরে ধীরে কথা বলা শুরু করলো একটু পর। প্রতিটি শব্দ মাপা। একদম ভেবেচিন্তে বলছে যা বলার। অনেকটা ক্যানভাসে যত্নের সাথে তুলির দাগ দেয়ার মতন।