কাঁধ ঝাঁকালো ইউরি। “আপনার যেমনটা ইচ্ছে। চলুন তাহলে।”
বেশ কয়েকবার করিডোর বদলে আর তালা দেয়া দরজা খোলা-বন্ধের পর উপস্থিত হলাম গন্তব্যে। খুব বেশি পরিচর্যার যে বালাই নেই, তা স্পষ্ট। পলেস্তারা খসে পড়ছে জায়গায় জায়গায়, চুনকাম উঠে গেছে অনেক আগেই। বাতাসে শেওলার গন্ধ।
“ভেতরেই আছে সবাই,” বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলল ইউরি।
“ঠিক আছে, ধন্যবাদ।”
এক মুহূর্তে থেমে নিজেকে তৈরি করে নিলাম। এরপর দরজা ঠেলে পা রাখলাম ভেতরে।
.
১.৫
লম্বা একটা ঘরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কম্যুনিটি মিটিং। ঘরটার জানালায় জেলখানার মত পুরু গারদ। বাইরে লাল ইটের দেয়াল দেখা যাচ্ছে। কফির ঘ্রাণ পেলাম (ইউরির আফটার শেভের গন্ধ ছাপিয়ে খুব কম ঘ্রাণই অবশ্য নাক অবধি পৌঁছুতে পারছে)। ভেতরে জনা তিরিশেক মানুষ গোল হয়ে বসে আছে। বেশিরভাগেরই হাতে চা অথবা কফির কাপ, খানিক পরপর হাই তুলছে ঢুলুঢুলু চোখে। যাদের কফি খাওয়া শেষ তারা হাতের কাপটা নাড়াচাড়া করছে অথবা সেটা দিয়ে বিভিন্ন নকশা করার চেষ্টা করছে।
সাধারণত গ্রোভের মত মানসিক স্বাস্থ্যের ইনস্টিটিউটগুলোয় দিনে এক দু’বার সকলে এভাবে দেখা করে। এটাকে মিটিংও বলতে পারেন, আবার গ্রুপ থেরাপি সেশনও বলতে পারেন। ইউনিটের যাবতীয় কার্যক্রম অথবা রোগিদের বিষয়াদি নিয়েও বিস্তারিত আলাপ হয় এখানে। প্রফেসর ডায়োমেডেসের ভাষায় রোগিরা নিজেদের চিকিৎসায় যাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং সচেতন হতে পারে, সেটারই একটা প্রচেষ্টা এই মিটিংগুলো। তবে প্রচেষ্টাটা যে সবসময় সফল হয়, তা বলা যাবে না। গ্রুপ থেরাপি বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতার দরুণ মি, ডায়োমেডেস বরাবরই মিটিং বা গ্রুপ ওয়ার্কের ভক্ত। নাটকের কুশীলবরা যেরকম মঞ্চের সামনে জড়ো হওয়া লোকদের উপস্থিতিতে কাজ করে মজা পায়, প্রফেসর ডায়োমেডেসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এমনকি আমাকে স্বাগত জানানোর জন্যে তার উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গির মধ্যেও কিছুটা নাটুকেপনা খুঁজে পেলাম। হাত বাড়িয়ে আমাকে সামনে এগোনোর ইশারা করলেব তিনি।
“থিও। এসে পড়েছে তাহলে। বসো আমাদের সাথে।“
কথার ভঙ্গিতে খানিকটা গ্রিক টান, তবে সহজে ধরা যাবে না। ত্রিশ বছরের বেশি ইংল্যান্ডে থাকার কারণে টানটা হারিয়েই যেতে বসেছে। বয়স সত্তরের কোঠায় হলেও চেহারার সুদর্শন ভাবটা মুছে যায়নি। বরং কম বয়সি হঁচড়েপাকা ছেলেমেয়েদের অভিব্যক্তির সাথে মিলে যায় তার অভিব্যক্তি। যেন সাইকিয়াট্রিস্ট নন, ভাগনে-ভাগ্নিদের পছন্দের মামা। তবে রোগিদের দেখাশোনার ব্যাপারে কিন্তু কোন গাফিলতি নেই তার, সকালে ইউনিটের ক্লিনারদের আগে চলে আসেন তিনি। এরপর নাইট শিফট চালু হবারও বেশ কিছুক্ষণ পর অবধি থাকেন, মাঝে মাঝে তো রাতটা অফিসের কাউচে শুয়েই কাটিয়ে দেন। দু’বারের ডিভোর্সি মি. ডায়োমেডেসের জন্যে গ্রোভই সবচেয়ে বড় অবলম্বন।
“এখানে বসো, নিজের পাশের খালি চেয়ারটার দিকে ইঙ্গিত করলেন প্রফেসর। “বসো, বসো, বসো।”
তার কথা অনুযায়ী বসে পড়লাম সেখানে।
বেশ আগ্রহ নিয়ে আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ডায়োমেডেস। “আমাদের নতুন সাইকোথেরাপিস্টের সাথে পরিচিত হও সবাই। থিও ফেবার! আমার মতন তোমরাও ওকে গ্রোভ পরিবারে আপন করে”
ডায়োমেডেসের পরিচয় সম্ভাষণ চলার ফাঁকে আমার চোখ অ্যালিসিয়াকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও দেখলাম না তাকে। ঘরে একমাত্র প্রফেসর ডায়োমেডেসই স্যুট-টাই চাপিয়ে এসেছেন, বাকিদের পরনে হাফহাতা শার্ট বা গেঞ্জি। দেখে বোঝা মুশকিল যে কে রোগি আর কে স্টাফ।
কয়েকজন অবশ্য আমার পূর্বপরিচিত, যেমন-ক্রিস্টিয়ান। ব্রডমুরে থাকতে ওর সাথে পরিচয় হয়েছিল। চেহারায় রাগবি খেলোয়াড়দের মতন রুক্ষতা (আসলেও রাগবি প্লেয়ার ছিল সে), থেবড়ানো নাক আর মুখভর্তি দাড়ি। অনেকের চোখেই হয়তো তাকে সুদর্শন ঠেকবে। আমি ব্রডমুরে যোগ দেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ওখান থেকে চলে আসে সে। ক্রিস্টিয়ানকে কখনোই খুব একটা ভালো লাগেনি আমার, তবে সত্যি কথা বলতে তার সাথে খুব বেশিদিন কাজও করিনি, তাই ঠিকমতো চিনি এটাও বলা যাবে না।
ইন্টারভিউতে ইন্দিরার সাথে পরিচয় হয়েছিল। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন একবার, গোটা দলটার মধ্যে একমাত্র তার আন্তরিকতার মধ্যেই কোন খাদ নেই। রোগিদের বেশিরভাগই চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, দৃষ্টিতে অবিশ্বাস। আসলে তাদের যে ধরণের শারীরিক, যৌন বা মানসিক নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তাতে এ ধরণের আচরণই কাম্য। আমাকে পুরোপুরি ভরসা করে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। আরেকটা ব্যাপার, রোগিদের সবাই নারী। অনেকেরই শরীরের নানারকমের ক্ষতচিহ্ন। এটা স্পষ্ট যে গ্রোভে আসার আগে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাদের। আর সেই যন্ত্রনা এতটাই প্রবল যে মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে পুরোপুরি। দুর্বিষহ অতীতের ছাপ তাদের প্রত্যেকের চেহারায় একদম পরিস্কার।
কিন্তু অ্যালিসিয়া বেরেনসন? সে কোথায়? আরো একবার ঘরে উপস্থিত সবার ওপরে নজর বুলালাম, কিন্তু খুঁজে পেলাম না তাকে। এরপর হঠাৎই আবিষ্কার করলাম যে আমার উল্টোদিকে বসে থাকা মানুষটাই অ্যালিসিয়া। এতক্ষণ তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম।