“অ্যালিসিয়াকে খুন করেছিল।”
মনে হলো যেন ভুল শুনছি। “অ্যালিসিয়াকে খুন করেছিল? মাথা ঠিক আছে তো আপনার?”
জবাবে উঠোনের দিকে দেখালো পল। “মা’র সাথে সেদিন ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল ভার্নন মামা। গলা পর্যন্ত মদ গিলেছিল। মা বারবার চেষ্টা করছিল তাকে ভেতরে নিয়ে যেতে, কিন্তু পারেনি। অ্যালিসিয়ার উদ্দেশ্যে চেঁচাচ্ছিল মামা। খুব রেগে ছিল ওর ওপরে।”
“অ্যালিসিয়া লুকিয়ে ছিল সেজন্যে? কিন্তু আগের দিন যে বাচ্চা মেয়েটার মা মারা গেছে, সে তো এমন করতেই পারে।”
“বললাম না, ভার্নন মামা মানুষ ভাল ছিল না। ইভা মামীই ছিল তার জীবনের সবকিছু, ব্যস। সেজন্যেই কাজটা করেছিল।”
“কি করেছিল?” ধৈৰ্য্য সামাল দেয়া কষ্টকর হয়ে উঠছে ক্রমশই। “একটু পরিস্কার করে বলুন সবকিছু।”
“ইভা মামীকে কতটা ভালোবাসে এসব বলছিল বারবার চিৎকার করে। “কেন মারা গেল ইভা? কেন? ওর জায়গায় অ্যালিসিয়া কেন মরলো না?”
ভাষা হারিয়ে ফেললাম কিছুক্ষণের জন্যে। “ওর জায়গায় অ্যালিসিয়া কেন মরলো না?”
“হ্যাঁ, এটাই বলেছিল সেদিন।”
“আর এখান থেকে সব শুনতে পায় অ্যালিসিয়া?
“হ্যাঁ। এরপর আমার উদ্দেশ্যে ফিসফিস করে অ্যালিসিয়া যে কথাটা বলে, সেটা আমি কখনো ভুলবো না। এর চেয়ে বাবা আমাকে খুন করতো।”
এ মুহূর্তে বিস্ফোরিত নয়নে পলের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই আমার। এরকম একটা কথা শোনার পর কি-ই বা বলা যেতে পারে?
তবে আমি যা খুঁজছিলাম এতদিন, তা পেয়ে গেছি। ধাঁধার শেষ সূত্রটা।
***
লন্ডনে ফেরার পথে গোটা সময় পলের কাছ থেকে শোনা কথাগুলো নিয়ে ভাবলাম। এখন বুঝতে পারছি, কেন অ্যালসেস্টিস নাটকটা দেখে এতটা প্রভাবিত হয়েছিল অ্যালিসিয়া। সেখানে অ্যাডমেতাস যেমন অ্যালসেস্টিসকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, তেমনি দুর্ঘটনায় ইভা মারা যাবার পর ভার্নন রোজও অ্যালিসিয়াকে ঠেলে দেয় মৃত্যুর পথে। তবে পার্থক্যটা হলো অ্যালিসিয়ার মৃত্যুটা মানসিক। আর অ্যাডমেতাস একটু হলেও ভালোবাসতো অ্যালসেস্টিসকে। কিন্তু ভার্নন রোজের ক্ষেত্রে কথাটা প্রযোজ্য নয়। ঠিকই বলেছে পল, সেদিন রাতে আসলেও খুন করেছিল লোকটা
‘এর চেয়ে বাবা আমাকে খুন করতো’-কতটা কষ্ট পেলে একজন মানুষ একথা বলে?
এতদিনে ধাঁধার টুকরোগুলো ঠিক জায়গামত বসে যাচ্ছে। ছোটবেলায় এরকম মানসিক আঘাত ভবিষ্যতে যে কারো মানসিকতায় বিস্তর প্রভাব ফেলে-এটা খুব ভালো করেই জানা আছে আমার। চিন্তা করে দেখুন বিষয়টা, আপনার নিজের বাবা বলছে যে আপনি মারা গেলেই তিনি খুশি হতেন। এরকম নিদারুণ মানসিক আঘাত ভাষায় প্রকাশ করা কোনভাবেই সম্ভব নয় মানুষের পক্ষে। এ কথা শুনে নিজের আত্মমর্যাদা চৌচির হয়ে যাবে যে কারো, আর অ্যালিসিয়া তখন নেহায়েতই একজন কিশোরী। কষ্টটা গিলে ফেলা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না তার। কিন্তু এরকম গ্লানি বা ক্রোধ ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায় না। পরিণত বয়সে ঠিকই কোন না কোন কাজের মাধ্যমে বাইরে বেরিয়ে আসে। অ্যালিসিয়ার ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছে। তবে তার প্রতিশোধের আগুনের শিকার হয়েছে গ্যাব্রিয়েল বেরেনসন, যে লোকটাকে ভালোবাসতো সে, যার প্রতি নিজের জীবন সঁপে দিয়েছিল।
যখন গ্যাব্রিয়েলের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে পাঁচবার গুলি চালায় অ্যালিসিয়া, তখন কিন্তু কারণটা জানা ছিল না তার। অজান্তেই কাজটা করে
আঁধার কেটে লন্ডনের দিকে ছুটে চলেছে ট্রেন। অবশেষে, ভাবলাম, অবশেষে আমি জানতে পেরেছি কিভাবে অ্যালিসিয়ার নাগাল পাবো।
এবারে আসল কাজ শুরু করা যাবে।
.
৪.৯
চুপচাপ অ্যালিসিয়ার সামনে বসে আছি।
ইদানীং আর এই নীরবতাটুকু আগের মত অসহ্য লাগে না। মানুষের স্বভাবই এমন, সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে পারে। সত্যি বলতে ছোট ঘরটায় অ্যালিসিয়ার মুখোমুখি দীর্ঘ সময় বসে থাকাটা স্বাভাবিকই মনে হয় এখন।
নির্দিষ্ট ছন্দে হাতের মুঠো একবার খুলছে আবার বন্ধ করছে অ্যালিসিয়া, অনেকটা হৃৎস্পন্দনের মত। আমার দিকে ঘুরে থাকলেও তার দৃষ্টি জানালার বাইরে। বৃষ্টি থেমেছে কিছুক্ষণ আগে। মেঘ সরে গিয়ে বিবর্ণ আকাশ দেখা যাচ্ছে অল্পসময়ের জন্যে, আবার কিছুক্ষণ পর সেটুকুও ঢাকা পড়ছে।
“আপনার ফুপাতো ভাইয়ের কাছ থেকে একটা ঘটনার কথা জানতে পেরেছি।”
যতটা সম্ভব নরম সুরে বললাম কথাটা। অ্যালিসিয়া কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না, তাই কথা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
“পল বলেছে যে আপনার মা মারা যাবার পরদিন খুব খারাপ একটা কথা বলেছিলেন মি, ভার্নন রোজ। উত্তেজিত অবস্থায় এক পর্যায়ে আপনার মৃত্যু কামনা করেছিলেন তিনি।”
ভেবেছিলাম কথাটা শোনার পর হয়তো কোন না কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবে অ্যালিসিয়া, কিন্তু সেরকম কিছু হলো না।
“আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন, পল এই কথাটা আমাকে জানিয়ে ঠিক করেনি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনাকে সাহায্য করার আশাতেই তার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম।”
এবারেও মুখ খুলল না অ্যালিসিয়া।
“আপনার একটা বিষয় জানা উচিৎ, তাহলে বোধহয় বুঝতে সুবিধা হবে। সত্যটা হচ্ছে, আমি আপনার পরিস্থিতি খুব ভালো করেই অনুধাবন করতে পারছি। কারণ ছোটবেলায় আমাকেও একই রকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। আমরা দুজনেই অল্প বয়সে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছি। কিন্তু খুব শিঘ্রই আবিষ্কার করতে হয়েছে যে ওভাবে ছুটে পালানোই সব সমস্যার সমাধান নয়। কিছু কিছু ব্যাপার চাইলেও ভোলা যায় না। আপনার শৈশব কতটা কঠিন কেটেছে তা জানি আমি। ব্যাপারটার গুরুত্ব আপনাকে বুঝতে হবে। আপনার বাবা মানসিকভাবে হত্যা করেছিলেন আপনাকে।”