“ওহ, একটা জিনিস আপনাকে জিজ্ঞেস করতে বারবার ভুলে যাই। তানিয়া বলেছিল কথাটা।”
“তানিয়া বেরেনসন? তার সাথে কথা হয়েছে আপনার?”
“খুব সামান্য। সে-ই আমাকে বলে আপনার সাথে কথা বলতে।”
“তাই?” লাল হয়ে গেছে পলের গাল। “আমি…আমি আসলে খুব ভালো করে চিনি না তাকে। কিন্তু যতবার দেখা হয়েছে খুব ভালো ব্যবহার করেছে আমার সাথে। খুব ভালো মানুষ। দু’বার আমাদের বাসাতেও এসেছিল।” হাসি ফুটেছে পলের মুখে।
তানিয়ার প্রেমে পড়েছে পল, ভাবলাম। ম্যাক্স বিষয়টাকে কিভাবে নেবে কে জানে।
“তানিয়া কী বলেছে?”
“বলছিল, আপনাকে অ্যালিসিয়ার মায়ের দুর্ঘটনার পরের দিনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে। বিস্তারিত শোনার সুযোগ পাইনি।”
“ওহ, আমি জানি কি বলতে চেয়েছিল তানিয়া। আসলে ঘটনাটা বিচার চলাকালীন সময়ে আমিই বলেছিলাম তাকে। সেই সাথে কাউকে বলতে নিষেধ করে দেই।”
“সেজন্যেই আপনাকে জিজ্ঞেস করতে বলেছে। তবে বলবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত আপনার। না বলতে চাইলে…”
এক চুমুকে গ্লাস খালি করে ফেললো পল। “আসলে ওরকম কিছু না। কিন্তু অ্যালিসিয়াকে বুঝতে হয়তো সুবিধে হবে আপনার। ও…” চুপ হয়ে গেল সে।
“বলুন।”
“অ্যালিসিয়া…দুর্ঘটনার পরদিন হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর ছাদে চলে যায় সে। আমিও যাই ওর পিছু পিছু। সারা রাত সেখানেই ছিলাম। ছোট থাকতেও এমনটা করতাম আমরা।”
“ছাদে গিয়ে বসে থাকতেন?”
দ্বিধা ভর করলো পলের চেহারায়। আমার দিকে তাকিয়ে চিন্তা করে কিছুক্ষণ। এরপর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
“চলুন,” উঠে দাঁড়াল সে। “আপনাকে দেখাই।”
.
৪.৮
আমরা পৌঁছে দেখি পুরো বাড়ি অন্ধকার।
“আসুন আমার সাথে,” পল বলে ফিসফিস করে।
বাড়ির এক পাশে লোহার পুরনো মই লাগানো। জমে যাওয়া কাদার ওপর দিয়ে হেঁটে সেদিকে এগিয়ে গেলাম দুজনে। আমার জন্যে অপেক্ষা না করেই মই বেয়ে উঠতে শুরু করলো পল।
খুব বেশি ঠাণ্ডা লাগছে এখন। এরকম সময়ে ছাদে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে কি না বুঝতে পারছি না। তবুও মইয়ে পা রাখলাম। তুষারের কারণে পিচ্ছিল হয়ে আছে।
ধীরে ধীরে উপরে উঠতে লাগলাম। ছাদে পৌঁছাতে পৌঁছাতে হাতের আঙুলগুলো রীতিমত অবশ হয়ে গেল, বরফ শীতল বাতাসের ঝাঁপটা তো আছেই। কিশোরসুলভ হাসি নিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল পল। আকাশে এক টুকরো বাঁকা চাঁদ মেঘের আড়াল থেকে মাঝেমাঝে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। আলো বলতে ওটুকুই।
হঠাই আমার দিকে পলকে এগিয়ে আসতে দেখে ভয় পেয়ে যাই। হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় সে। ভেবেছিলাম ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলেই দিবে বুঝি। ডানদিকে ঘুরে যাই সাথে সাথে, কিন্তু শক্ত করে আমাকে ধরে ফেলে পল।
“বেশি কিনারায় যাবেন না, মাঝে থাকুন,” বলে সে।
মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। আসলে হুট করে এখানে আসাটা একদমই উচিৎ হয়নি আমার। পলের আশপাশে নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছি না কিছুতেই। নিচে নামার কথা বলবো এমন সময় পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমাকে সাধলো সে। এক মুহূর্ত দ্বিধা করে হাত বাড়িয়ে দিলাম। সিগারেট মুখে দিয়ে জ্বালবার সময় আঙুলগুলো কাঁপছিল।
চুপচাপ কিছুক্ষণ সিগারেট টানলাম দুজনে।
“এখানেই বসতাম আমরা। আমি আর অ্যালিসিয়া। প্রায় প্রতিদিন।”
“আপনাদের বয়স কেমন ছিল তখন?”
“আমার আট, অ্যালিসিয়ার দশ।”
“তাহলে তো মই বেয়ে ছাদে ওঠাটা বিপজ্জনক ছিল।”
“হয়তো। কিন্তু তখন আমাদের কাছে সেরকম কিছু মনে হতো না। বয়স একটু বাড়ার পর এখানে বসে লুকিয়ে সিগারেট খেতাম আর ড্রিঙ্ক করতাম আমরা।”
কিশোরী অ্যালিসিয়ার চেহারা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। বাবা আর বিরক্তিকর ফুপির কাছ থেকে লুকিয়ে ছোট ভাইয়ের সাথে এখানে বসে থাকতো সে। হয়তো একা একা সময় কাটানোর জন্যে ছাদে আসতো, কিন্তু পলের জন্যে সেটা সম্ভব হতো না।
“লুকোনোর জন্যে জায়গাটা আদর্শ,” বললাম।
মাথা নাড়লো পল। “ভার্নন মামা মই বেয়ে ওপরে উঠতে পারতো না, ওজনের কারণে।”
“আমারই তো কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। ওই গাছটার পাতাগুলোর কারণে কিন্তু পা পিছলে যায়। একদম মইয়ের সাথে লেগে থাকে।”
“জুই গাছ, সবুজ পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল পল। “বসন্তে ফুল ফুটবে। খুব সুন্দর ঘ্রাণ।”এক মুহূর্তের জন্যে স্মৃতির দেশে হারিয়ে গেল সে। “কেমন যেন…”
“কি কেমন যেন?”
“কিছু না,” কাঁধ নাচালো পল। “উঁই গাছটা নিয়েই ভাবছিলাম। অ্যালিসিয়ার মা, ইভা যখন মারা যায়, গাছভর্তি ফুল ছিল তখন।”
তার দিকে তাকালাম। “আপনি আর অ্যালিসিয়া পরদিন এখানে এসেছিলেন, তাই না?”
মাথা নেড়ে সায় জানালো পল। “মা আর ভার্নন মামা আমাদের খুঁজছিল। তাদের ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু জবাব দেইনি। লুকিয়েই থাকি এখানে। ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটে।”
সিগারেট ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা হাসি দিল পল। “সেজন্যেই আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি। আপনি তাহলে ক্রাইম সিনটা দেখতে পাবেন।”
“ক্রাইম সিন?”
জবাব দিল না পল, এখনও হাসছে।
“কিসের কথা বলছেন, পল?”
“আমার চোখে ভার্নন মামা সেদিন থেকেই অপরাধী, জানেন? তাকে কোনভাবেই ভালো মানুষ বলা যাবে না।”
পলের হেঁয়ালি কথাবার্তা মাথায় ঢুকছে না।
“অপরাধী?”
“সেদিন রাতেই কাজটা করেছিল মামা।”
“কোন কাজ?”