অবশেষে একটা কেবিনে খুঁজে পেলাম পলকে। জায়গাটা ফায়ারপ্লেসের কাছাকাছি হওয়ায় বেশ গরম। তবে দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বসার কারণে তার চেহারাটা এখনও দেখতে পাচ্ছি না। তাকে চেনার জন্যে অবশ চেহারা দেখার কোন দরকার নেই। বিশাল দেহটাই যথেষ্ট।
“পল?”
চমকে উঠে ঘুরে তাকালো সে। ছোট্ট কেবিনটায় বেমানান লাগছে তাকে।
“ঠিক আছেন?” চেহারা দেখে মনে হচ্ছে খারাপ খবর শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে। চেপে আমার জন্যে জায়গা করে দিল। আগুনের কাছাকাছি কেবিনটা বেছে নেয়ার কারণে তাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম।
“লন্ডনের থেকে এখানে ঠাণ্ডা অনেক বেশি।”
“সরাসরি সাইবেরিয়া থেকে বাতাস আসে এখানে,” পল বলল। “ডায়েরির ব্যাপারে যেন কী বলছিলেন ফোনে?” আর তর সইছে না তার। “অ্যালিসিয়া ডায়েরি লিখতো এটা জানতাম না আমি।”
“না জানারই কথা।”
“সেটা আপনাকে পড়তে দিয়েছে?”
মাথা নেড়ে সায় জানালাম।
“কী লেখা সেখানে?”
“আপনাদের শেষ যেবার দেখা হয়েছিল, সেসম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছে অ্যালিসিয়া। হত্যাকাণ্ডের দু’মাস আগের ঘটনা। কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়েছে আমার।”
“কী রকম অসঙ্গতি?”
“আপনি আমাকে যা বলেছিলেন তার সাথে অ্যালিসিয়ার ডায়েরির লেখার মিল নেই।”
“কি বলছেন এসব?” হাতের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে উদ্বিগ্ন চোখে আমার দিকে তাকালো পল।
“এই যেমন আপনি বলেছিলেন হত্যাকাণ্ডের আগে বেশ কয়েক বছর আপনার সাথে দেখা হয়নি অ্যালিসিয়ার।”
“তাই বলেছিলাম নাকি?” পলের কণ্ঠে দ্বিধা।
“আর ডায়েরিতে অ্যালিসিয়া লিখেছে গ্যাব্রিয়েল মারা যাবার কয়েক সপ্তাহ আগে আপনাদের দেখা হয়েছে। আপনি নাকি তার বাসায় গিয়েছিলেন।”
দৃশ্যতই চুপসে গেল পল। এখন মনে হচ্ছে চুরি করে ধরা পড়ে গেছে এমন কোন বাচ্চা ছেলের সামনে বসে আছি। ভয় পেয়েছে সে, এটা পরিস্কার। বেশ কিছুক্ষণ কিছু বলল না সে। মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে রেখেছে।
“আমি কি একবার ডায়েরিটা দেখতে পারি?”
মাথা ঝাঁকালাম জবাবে। “না। সেটা উচিৎ হবে না বোধহয়। তাছাড়া সাথে করে নিয়েও আসিনি আমি।”
“তাহলে আমি কি করে বিশ্বাস করবো, আপনি সত্যিটাই বলছেন?”
“মিথ্যে বলার কোন কারণ আমার নেই, পল। কিন্তু আপনি আমাকে মিথ্যে বলেছেন, কেন?”
“সেসবের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই, এজন্যে বলিনি।”
“সম্পর্ক নেই কথাটা ভুল বললেন। অ্যালিসিয়ার ব্যাপারে সবকিছু জানা দরকার আমার। আমি তাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করছি।”
“কিন্তু ওর সুস্থ হবার সাথেও তো এসবের কোন লেনদেন নেই। আমি তো ওর কোন ক্ষতি করিনি।”
“আমি কিন্তু বলিনি যে আপনি তার ক্ষতি করেছেন।”
“তাহলে?”
“আপনিই নাহয় পুরোটা খুলে বলুন।”
কাঁধ ঝাঁকালো পল। “লম্বা কাহিনী।” বলবে কি বলবে না এটা নিয়ে কিছুক্ষণ দোটানায় ভুগে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেললো শেষমেষ। খুব দ্রুত কথা বলতে শুরু করলো এরপর। এতদিন চেপে রাখা কথাগুলো কাউকে বলতে পেরে যে শান্তি পাচ্ছে সে, তা বুঝতে পারছি। “খুব বাজে একটা সমস্যায় ফেঁসে গিয়েছিলাম। জুয়া খেয়ালার বদভ্যাস আছে আমার। সে কারণেই অনেকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছি বিভিন্ন সময়ে। তাদের একজন এমনভাবে চাপ দিতে শুরু করে যে নগদ কিছু না দিলে হচ্ছিলোই না।”
“তাই অ্যালিসিয়ার কাছে টাকা চেয়েছিলেন? দিয়েছিল সে কিছু?”
“ডায়েরিতে কি লেখা?”
“কিছু লেখা নেই এ ব্যাপারে।”
এক মুহূর্ত ইতস্তত করে মাথা ঝাঁকালো পল। “না, দেয়নি। বলেছিল ওর কাছে টাকা নেই।”
আবারো মুখের ওপরে মিথ্যে বলল সে। কেন?
“তাহলে টাকাটা কিভাবে জোগাড় করেছিলেন?”
“আমি-আমি আমাদের সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্ট থেকে কিছু টাকা তুলি। দয়া করে কথাটা কাউকে বলবেন না, মা জানতে পারলে তুলকালাম বাধিয়ে দিবে।”
“লিডিয়াকে এসবে জড়ানোর কোন প্রয়োজন দেখছি না।”
“আসলেই?” মুখে রঙ ফিরলো পলের। আগের চেয়ে স্বস্তিবোধ করছে এখন। “অনেক ধন্যবাদ।”
“অ্যালিসিয়া কি কখনো আপনাকে এ ধরণের কিছু বলেছিল যে কেউ নজর রাখছে তার ওপরে?”
গ্লাস নামিয়ে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো পল। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে এরকম কিছু শোনেনি।
অ্যালিসিয়ার সন্দেহের ব্যাপারে বিস্তারিত সবকিছু তাকে খুলে বললাম।
মাথা ঝাঁকালো পল। “ওর মাথায় একটু সমস্যা ছিল আগে থেকেই।”
“আপনার ধারণা পুরোটাই ওর কল্পনা?”
“সেরকমটা হবার সম্ভাবনাই তো বেশি, তাই না?” পল কাধ নাচিয়ে বলল। “আপনার কি মনে হয়? পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যায় না অবশ্য সম্ভাবনাটা, কেউ হয়তো আসলেই-”।
“-নজর রাখছিল তার ওপরে,” পলের মুখের কথা টেনে নিয়ে বলি। “আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেনি তাহলে।”
“নাহ। আসলে অ্যালিসিয়া আর আমার কখনোই খুব বেশি কথা হতো না। চুপচাপ থাকতেই পছন্দ করতো ও। আমাদের পরিবারটাই অমন ছিল। অ্যালিসিয়া প্রায়ই বলতো, অন্যান্য বাসাবাড়িতে পরিবারের সবাই হাসিঠাট্টা করে, কথা বলে। কিন্তু আমাদের বাসায় কখনো অমনটা হতো না, এটা অদ্ভুত লাগতো তার কাছে। মা শুধু একের পর এক আদেশ দিয়ে যেত, আর আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম।”
“আর অ্যালিসার বাবা? ভার্নন? তিনি কেমন ছিলেন?”
“ভার্ননও খুব বেশি কথা বলতো না। ইভা মারা যাবার পর থেকেই একটু অন্যরকম হয়ে যায় সে। অ্যালিসিয়ার ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য।”