“লোকটা একটু কেমন যেন। গ্রুপ থেরাপি নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছেন। ফোকসের সাথেও কাজ করেছেন কিছুদিন। আশির দশকে হার্টফোর্ডশায়ারে বিকল্প ভেষজ চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু অর্থনৈতিক বিবেচনায়, বিশেষ করে এখনকার দিনে একেবারেই অচল…” এক মুহূর্ত ইতস্তত করার পর গলা নামিয়ে নেয় সে। “তোমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছি না, থিও। কিন্তু গুজব কানে এসেছে যে জায়গাটা বন্ধ করে দেয়া হবে। হয়তো ছয় মাস পরেই তোমাকে নতুন চাকরি খুঁজতে হবে…এগুলো জানার পরেও সিদ্ধান্ত বদলাবে না?”
“না,” ভদ্রতার খাতিরে ইতস্ততার অভিনয় করে বললাম।
মাথা ঝাঁকায় কনসালটেন্ট। “নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত যেহেতু নিয়েই নিয়েছো…”।
তাকে অ্যালিসিয়া বেরেনসনের ব্যাপারে কিছু বলিনি আমি। তার চিকিৎসার জন্যেই যে গ্রোভে যোগ দিচ্ছি এটা চেপে গিয়েছি ইচ্ছে করেই। হয়তো বুঝিয়ে বলতেও পারতাম। অ্যালিসিয়ার সাথে কাজ করলে ভবিষ্যতে ঘটনাটা নিয়ে বই লিখতে পারবো বা কোন জার্নালে পেপার পাব্লিশ হবে; তবুও দেখা যেত, আমার ভুল ধরছে সে। হয়তো ঠিকই বলছিল। কিছুদিনের মধ্যেই জানতে পারবো।
সিগারেট নিভিয়ে নিজেকে কিছুটা ধাতস্ত করে ভেতরে প্রবেশ করি।
এডগোয়ের হাসপাতালের সবচেয়ে পুরনো অংশটায় গ্রোভের অবস্থান। লাল ইটে তৈরি ভিক্টোরিয়ান নকশার বিশাল মূল দালানটার বাইরে অনেক আগেই বাড়তি কিছু ভবন জুড়ে দেয়া হয়েছে। দ্য গ্রোভ এই বিশাল কমপ্লেক্সের একদম মাঝামাঝি। ভেতরের বাসিন্দারা যে খুব একটা সুবিধার নয় সেটা বোঝা যাবে বাইরের সারি সারি সিসিটিভি ক্যামেরা দেখে। রিসিপশনে অবশ্য চেষ্টা করা হয়েছে স্বাভাবিক একটা পরিবেশ ফুটিয়ে তোলার। নীল রঙের বড় কয়েকটা কাউচ আর দেয়ালে রোগিদের আঁকা কিছু ছবি শোভা পাচ্ছে সেখানে। সুরক্ষিত সাইকিয়াট্রিক ইউনিট তো নয়, যেন বাচ্চাদের কিন্ডারগার্ডেন।
লম্বা একজন লোক উদয় হলো আমার পাশে। হেসে হাত বাড়িয়ে দিল। নিজের নাম বলল ইউরি, গ্রোভের হেড সাইকিয়াট্রিক নার্স। “গ্রোভে আপনাকে স্বাগতম। দুঃখিত, আমি বাদে আর কেউ আসেনি আপনাকে স্বাগত জানাতে।”
ইউরির বয়স চল্লিশের কোঠায়, দেখতে শুনতে ভালোই, পেটানো শরীর। কালো চুল, গলার কাছে কলারের নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা ট্যাটু। তামাক আর আফটারশেভের কড়া গন্ধ নাকে এসে লাগলো। “সাত বছর আগে লাটভিয়া থেকে এখানে আসি আমি। তখন অবশ্য একদমই ইংরেজি জানতাম না, কিন্তু এক বছরের মধ্যে আয়ত্ত করে ফেলি।”
“দারুণ।”
“আসলে ইংরেজি সহজ একটা ভাষা। লাটভিয়ানে কথা বলার চেষ্টা করলেই বুঝবেন।”
হেসে কোমড়ে ঝোলানো চাবির গোছার দিকে হাত বাড়ালো সে। সেখান থেকে এক সেট চাবি বের করে আমার হাতে দিল। “রুমগুলোর জন্যে এগুলো লাগবে আপনার আর ওয়ার্ডে প্রবেশের জন্যে কিছু কোড আছে।”
“অনেক চাবি তো এখানে। ব্রডমুরে এতগুলো নিয়ে ঘুরতে হতো না।”
“আসলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কিছুটা জোরদার করা হয়েছে কদিন ধরে। বিশেষ করে স্টেফানি কাজে যোগ দেয়ার পর থেকে।”
“স্টেফানি কে?”
জবাবে কিছু না বলে রিসিপশন ডেস্কের পেছনের অফিস থেকে বেরিয়ে আসা একজনের দিকে ইশারা করলো ইউরি।
মাঝ চল্লিশের এক ক্যারিবিয়ান নারী, মাথায় ছোট করে ছাঁটা চুল। “আমি স্টেফানি ক্লার্ক। গ্রোভের ম্যানেজার।”
মুখে একটা কাষ্ঠল হাসি ঝুলিয়ে রেখে আমার সাথে করমর্দন করলো সে। মনে হচ্ছে যেন এখানে আমার উপস্থিতি তার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।
“এই ইউনিটের ম্যানেজার হিসেবে নিরাপত্তার ব্যাপারে কোন ছাড় দিতে রাজি নই আমি। রোগি আর স্টাফ, দুই পক্ষকে নিরাপদ রাখাই আমার দায়িত্ব।” আমার হাতে একটা ছোট যন্ত্র ধরিয়ে দিল সে-পার্সোনাল অ্যাটাক অ্যালার্ম। “এটা সবসময় সাথে সাথে রাখবেন। মনে থাকে যেন।”
জি, ম্যাডাম, বলা থেকে খুব কষ্ট করে আটকালাম নিজেকে। স্টেফানিকে সন্তুষ্ট রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এর আগেও কঠোর ওয়ার্ড ম্যানেজারদের ক্ষেত্রে এই পন্থা অবলম্বন করেছি, এমন কিছু করা যাবে না যাতে তারা বিরাগভজন হয়।
“আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, স্টেফানি।” মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে রেখেছি আগে থেকেই।
জবাবে স্টেফানি অবশ্য হাসলো না। “ইউরি আপনাকে আপনার অফিস দেখিয়ে দিবে।” হনহন করে সেখান থেকে চলে গেল সে।
“আসুন আমার সাথে,” বলল ইউরি।
তার পেছন পেছন ওয়ার্ডের প্রবেশপথের সামনে এসে দাঁড়ালাম। একটা বড় স্টিলের তৈরি দরজা। ওটার পাশেই মেটাল ডিটেক্টর হাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন সিকিউরিটি গার্ড।
আমার দিকে তাকালো ইউরি। “আপনার নিশ্চয়ই নিয়ম কানুন জানাই আছে। ধারালো বা এমন কোনকিছু নিয়ে ভেতরে যাওয়া যাবে না যা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারযোগ্য।”
“লাইটারও নেয়া যাবে না।”পকেট হাতড়ে আমার লাইটারটা বের করে নিল গার্ড।
“দুঃখিত, ভুলে গিয়েছিলাম ওটার কথা।”
ওর পেছন পেছন যাবার ইশার করলো ইউরি। “আপনার অফিস দেখিয়ে দেই, চলুন। অন্য সবাই কম্যুনিটি মিটিংয়ে গেছে, তাই এত চুপচাপ।”
“আমিও যাবো?”
“মিটিংয়ে?” অবাক মনে হলো ইউরিকে। “আগে একটু গুছিয়ে নিন সবকিছু, নাকি?”
“আর গুছিয়ে নেয়ার কি আছে? পরে সময় দিতে পারবেন না?”