মাঝে মাঝে কথা বলার সময়ে রুথের চেহারার দিকে তাকাতাম। অবাক হয়ে খেয়াল করতাম যে তার চোখে কোণায় পানি জমেছে আমার কথাগুলো শুনতে শুনতে। হয়তো অবিশ্বাস্য শোনাবে-কিন্তু চোখের পানিগুলো আদতে তার ছিল না, ছিল আমার।
সেই সময়ে অবশ্য বুঝতে পারিনি। কিন্তু থেরাপি এভাবেই কাজ করে। অব্যক্ত অনুভূতিগুলোর ব্যাপারে সবকিছু থেরাপিস্টকে খুলে বলে রোগি, যে অনভূতিগুলোর মুখোমুখি হতে এতদিন ভয় পেয়ে এসেছে। তার হয়ে সেগুলো অনুভব করার দায়িত্ব থেরাপিস্টের। এরপর ধীরে ধীরে অনুভূতিগুলো আবারো রোগিকে ফিরিয়ে দেয় সে। রুথ আর আমার ক্ষেত্রেও অমনটা ঘটেছিল।
কয়েক বছর তার কাছে নিয়মিত যাতায়ত করি আমি। সেই সময়টুকুতে জীবনের অনেক কিছু বদলালেও রুথের সাথে দেখা করার বিষয়টা বদলায়নি। তার মাধ্যমে নতুন এক ধরণের সম্পর্ক অন্তরীণে সক্ষম হই, যে সম্পর্কটার ভিত তৈরি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সততা এবং মায়া দিয়ে। ক্রোধ, সহিংসতা বা কোন অভিযোগের স্থান নেই সেখানে। নিজের ব্যাপারে ধ্যান ধারণা ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে আমার অনুভূতিগুলো আর আগের মত ভয়ের উদ্রেক ঘটায় না। মাথার ভেতরে সেই কণ্ঠস্বরটার অস্তিত্ব মাঝে মাঝে টের পেতাম, তবে তার বিপরীতে রুথের কণ্ঠস্বরও কানে বাজতো। ফলে সময়ের সাথে একসময় নির্বাক হয়ে যায় কণ্ঠস্বরটা। প্রশান্তি ভর করে আমার মনে।
সাইকোথেরাপি আসলেও আমার জীবন বাঁচিয়েছে। শুধু তাই নয়, জীবনটাকে পুরোপুরি বদলেও দিয়েছে। এভাবে নির্ভয়ে কথা বলার মাধ্যমেই নিজেকে খুঁজে পাই এক পর্যায়ে। যদি কেউ আমায় নিজেকে বিশ্লেষণ করতে বলে, তবে এই কথাই বলবো।
পেশা হিসেবে তাই সাইকোথেরাপিই যে বেছে নিয়েছি, এতে কেউ নিশ্চয়ই অবাক হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্ব শেষ করে লন্ডনে সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে প্রশিক্ষণ নেই। প্রশিক্ষণের গোটা সময়টা রুথের সাথে নিয়মিত দেখা করতাম। তার দিক থেকে উৎসাহের কোন কমতি ছিল না, তবে বাস্তবতাটাও স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেনি। “ছেলেখেলা নয় কিন্তু ব্যাপারটা।” ঠিকই বলেছিল ও, আমার রোগিদের সাথে কাজ করতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাই।
প্রথম যেদিন সাইকিয়াট্রিক ইউনিটে যাই, সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে আমার। আমি সেখানে যাবার কয়েক মিনিটের মধ্যে এক রোগি সবার সামনে প্যান্ট খুলে মলত্যাগ শুরু করে। দুর্গন্ধে ছেয়ে যায় গোটা ঘরটা। সামনের দিনগুলোতে এরকম আরো ঘটনা ঘটে। আত্মহত্যার চেষ্টা, নিজের শরীরে কাটাকাটি, চিৎকার-চেঁচামেচি-এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল এসব বুঝি সহ্য হবে না আমার। কিন্তু প্রতিবারই সহনশীলতার পরিচয় দেই আমি। ধীরে ধীরে সহজ হয়ে আসে সবকিছু।
সাইকিয়াট্রিক ইউনিটের আপাত অদ্ভুত জগতটার সাথে কত সহজে মানিয়ে নেয়া যায়, এটা ভাবলে অবাকই লাগে। দৈনন্দিন উন্মাদনার সাথে একসময় নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয় সবাই। শুধু রোগিদের উন্মাদনার কথা বলছি না কিন্তু, নিজের উন্মাদনাও বিবেচ্য এই ক্ষেত্রে। আমার বিশ্বাস আমরা সবাই কোন না কোনভাবে ব্যধিগ্রস্ত।
আর সেজন্যেই অ্যালিসিয়া বেরেনসনের সাথে নিজেকে মেলাতে কষ্ট হয় না। আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন যে কি না তরুণ বয়সে সাইকোথেরাপির মাধ্যমে অন্ধকার অতীতকে পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। যদি সেরকমটা না হতো তাহলে আমাকেও হয়তো অ্যালিসিয়ার মতন কোন এক মানসিক হাসপাতালে বন্দি জীবন পার করতে হতো। ঈশ্বরের অশেষ অনুগ্রহে সেরকমটা হয়নি।
পেশা হিসেবে সাইকোথেরাপি কেন বেছে নিলাম, ইন্দিরা শর্মার এই প্রশ্নের জবাবে অবশ্য এগুলো বলার কোন উপায় ছিল না। হাজার হলেও চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এসেছি আমি। জানি, কী করতে হবে।
“সবশেষে আমি বলতে চাই, প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই একজন সাইকোথেরাপিস্ট তার আসল লক্ষ্য খুঁজে পায়। প্রাথমিক উদ্দেশ্যে যা-ই হোক না কেন।”
“হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। একদম ঠিক।” বিজ্ঞ ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন ইন্দিরা।
ইন্টারভিউটা খারাপ হয়নি। ব্রডমুরে কাজ করার অভিজ্ঞতাটা বাড়তি সুবিধা হিসেবে কাজ করেছে আমার জন্যে। ইন্দিরা বলেন, মাত্রাতিরিক্ত মানসিক ভারসাম্যহীন রোগিদের নিয়ে কাজ করা সম্ভব হবে আমার পক্ষে। কিছুক্ষণ বাদেই জানতে পারি যে চাকরিটা পেয়ে গেছি।
এর একমাস পর তল্পিতল্পা গুটিয়ে গ্রোভের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাই।
.
১.৪
জানুয়ারির এক শীতল দিনে গ্রোভে উপস্থিত হই আমি। বাইরে পাতাঝরা গাছগুলো কঙ্কালের মত দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ ধবধবে সাদা, কিছুক্ষণের মধ্যে তুষারপাত শুরু হবে।
প্রবেশপথের সামনে দাঁড়িয়ে পকেট হাতড়ে একটা সিগারেট বের করলাম। গত সাতদিন ধূমপান করিনি। নিজেকে নিজেই কথা দিয়েছিলাম যে সিগারেট ছেড়ে দেব। সেটা আর পারলাম কই। সিগারেট ধরিয়ে মুখে দিলাম, নিজের ওপর বিরক্ত। সাইকোথেরাপিস্টরা এই ধূমপানের আসক্তিটা একটু বাঁকা চোখেই দেখে, একজন থেরাপিস্ট হিসেবে নিজেকে এই আসক্তি থেকে মুক্ত করা আমার কাজের ভেতরে পড়ে। চাকরির প্রথম দিনেই আমার মুখ থেকে যাতে সিগারেটের গন্ধ পাওয়া না যায় সেজন্য একটা মিন্ট গাম চিবিয়ে নিলাম কিছুক্ষণ।
কিছুটা কাঁপছি আমি। যতটা না ঠাণ্ডায়, তার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায়। ব্রডমুরে আমার কনসালটেন্ট কোন রাখঢাক ছাড়াই মন্তব্য করেছিল, গ্রোভে যোগ দেয়াটা ভুল হচ্ছে আমার ক্যারিয়ারের জন্যে। তাছাড়া গ্রোভের পরিবেশ, বিশেষ করে প্রফেসর ডায়োমেডেসকে নিয়ে দৃশ্যতই বিরক্ত ছিল