মা কিন্তু মজাচ্ছলে কথাটা বলতো না। এখন যদি কোন সাইকিয়াট্রিস্ট বাবাকে দেখতো, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলতো, তিনি পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারে ভুগেছেন পুরোটা জীবন। আর তার এই মানসিক সমস্যার প্রভাব পড়েছে আমার মস্তিষ্কের বিকাশের ওপরে। শারীরিক নির্যাতন, জিনিসপত্র ভাঙচুর, কান্নাকাটি-এই হচ্ছে আমার শৈশব।
তবে কিছু আনন্দের মুহূর্তও ছিল; বিশেষ করে বাবা যখন বাসায় থাকতেন না। একবার ব্যবসার কাজে একমাসের জন্যে আমেরিকা গিয়েছিলেন তিনি। সেই তিরিশটা দিন আমি আর মা বাসায় নির্ভয়ে সময় কাটিয়েছি। সেবার ডিসেম্বরে প্রচুর তুষারপাত হয়েছিল। আমাদের বাগানের দিকে তাকালে মনে হতো কেউ বুঝি সাদা একটা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে সেখানে। মা’র সাথে স্নোম্যান বানিয়েছিলাম। পুরোটা বানানোর পর দেখা যায় যে স্নোম্যানটার অবয়ব বাবার সাথে মিলে গেছে। এমনকি তার মতন একটা ভুড়িও আছে। অবচেতন মনেই কাজটা করেছিলাম আমরা। পরে অবশ্য ইচ্ছে করেই বাবার হাতমোজা, হ্যাট আর ছাতাটাও জুড়ে দেয়া হয়। সবশেষে অনেকগুলো স্নোবল বানিয়ে সর্বশক্তিতে ছুঁড়ে দিতাম স্নোম্যানটার দিকে আর দুষ্ট বাচ্চাদের মতন হাসতাম একজন আরেকজনকে ধরে।
সেই রাতে ভারি তুষারঝড় হয়েছিল। মা তার ঘরে গেলে আমি কিছুক্ষণ ঘুমের ভান করে রুমে শুয়ে থাকি, এরপর সন্তর্পণে বেরিয়ে আসি বাগানে। দু’হাত বাড়িয়ে তুষারকণা নিয়ে খেলি আনমনে কিছুক্ষণ। আমার আঙুলের ডগায় ওগুলোকে উধাও হয়ে যেতে দেখি। তখনকার অনুভূতিটা আসলে ঠিক বলে বোঝাতে সম্ভব না আমার পক্ষে। একই সাথে আনন্দ আর হতাশা অনুভূত হওয়া কি সম্ভব? হাতের ওপর যখন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিলো তুষারকণাগুলো, মনে হচ্ছিল জীবনের আনন্দ হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ঘটনাটা মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে আমার বাড়ির চার দেয়ালের বাইরেও সৌন্দর্যে ভরপুর একটা জগত বিদ্যমান; সেই মুহূর্তে অবশ্য জগতটা আমার ধরাছোঁয়ার বাইরেই ছিল। এই স্মৃতিটা পরবর্তীতে আমার জীবনে বারবার ফিরে ফিরে এসেছে। ভয়ের নাগপাশে মোড়ানো সেই ক্ষণিকের স্বাধীনতা আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল, যেন আঁধারে মোড়ানো টিমটিমে এক আলোকবর্তিকা।
এটা বেশ বুঝতে পারি, বাঁচতে হলে, সুস্থ একটা জীবন পেতে হলে বাসা থেকে পালাতে হবে আমাকে; যতদূরে সম্ভব। কেবলমাত্র তখনই হয়তো কিছুটা নিরাপদ বোধ করতে পারবো। সেই সুযোগটা পাই আঠারো বছর বয়সে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার জন্যে যেরকম নম্বরের দরকার ছিল, তা পেয়ে যাই। সারে’র সেই বন্দিশালা থেকে বেরিয়ে আসি। ভেবেছিলাম অবশেষে মুক্তির স্বাদ পেতে যাচ্ছি।
কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম।
তখন জানতাম না, কিন্তু বাবার ছায়া অবচেতনভাবেই ততদিনে আমার গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে। বাসা থেকে যত দরেই পালাই না কেন, তার হাত থেকে কখনোই রেহাই পাবো না। মাথার ভেতরে সবসময়ই একটা কণ্ঠস্বর বলতে থাকবে, মানুষ হিসেবে আমি ব্যর্থ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রথম সেমিস্টারের প্রায় পুরোটাই সেই কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ করে আমাকে, অবস্থা এতটাই সঙ্গিন ছিল। প্রচণ্ড ভয়ের কারণে ঘর থেকে বাইরেই বেরুতে পারতাম না, কারো সাথে কথা বলা তো দূরের কথা। মনে হতো যেন বাসাতেই আছি। মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়ি, আশা ছেড়ে দেই। মুক্তির কোন উপায়ই খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
আপনাআপনিই একটা সমাধান উদয় হয় এসময়।
ওষুধের দোকানে দোকানে ঘুরে অনেকগুলো প্যারাসিটামল কিনি। ইচ্ছেকৃতভাবেই এক দোকান থেকে কয়েক পাতার বেশি নেইনি, কেউ হয়তো সন্দেহ করবে এই ভয়ে। কিন্তু সন্দেহটা অমূলকই ছিল বলতে গেলে, কেউ একবারের বেশি দু’বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেনি আমার দিকে। যেন সম্পূর্ণ অদৃশ্য একটা মানুষ আমি, অস্তিত্বহীন।
নিজের ঘরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার ভেতরেই কাঁপা কাঁপা হাতে প্যারাসিটামলগুলো প্যাকেট থেকে বের করি। অতগুলো ট্যাবলেট গিলতে অবশ্য বেশ কষ্ট হয়, তবুও জোর করে একটার পর একটা মুখে পুরতেই থাকি। এরপর বিছানায় উঠে পড়ে চোখ বুজে অপেক্ষা করি আসন্ন মৃত্যুর।
কিন্তু মৃত্যুও আমার ধারে-কাছে ঘেষেনি।
বরং প্রচণ্ড পেট ব্যথায় কুঁকড়ে উঠি কিছুক্ষণ বাদেই। বমির সাথে পেটের ভেতর থকে বেরিয়ে আসে আধ-গলা ট্যাবলেটগুলো। সেই অবস্থাতেই অন্ধকারে শুয়ে থাকি, পেটের ভেতরে যেন আগুন জ্বলছে। একসময় মনে হয় যেন অনন্তকাল কেটে গেছে। এরপর ধীরে ধীরে একটা জিনিস পরিস্কার হয় আমার কাছে। বোধোদয় বলা যেতে পারে ব্যাপারটাকে।
মৃত্যু আসলে কাম্য ছিল না আমার। আসলে, আমি তো তখন অবধি ঠিকভাবে জীবন শুরুই করিনি।
একটা আশার সঞ্চার হয় ভেতরে ভেতরে। আর সেই আশা থেকেই উপলব্ধি করি যে সাহায্য দরকার আমার।
রুথের বেশে সাহায্যটা উপস্থিত হয় আমার জীবনে। রুথ একজন সাইকোথেরাপিস্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সেলিং ইউনিট থেকে তার খোঁজ পাই। শুভ্র চলের রুথের আচার ব্যবহারে অভিভাবকসুলভ একটা ভাব ছিল। দাদী-নানিদের কাছ থেকে যেরকম আন্তরিকতা পাওয়া যায়, সেরকম। সহমর্মীতায় মোড়া তার হাসিটা দেখলেই স্বস্তিবোধ করতাম। ভরসা করতে ইচ্ছে হতো। প্রথমে অবশ্য খুব বেশি কথা বলতো না সে। আমিই বলতাম যা বলার, রুথ চুপ করে শুনে যেত। আমার বলা কথাগুলো পীড়াদায়ক হোক না কেন, ভেতরে ভেতরে কিছুই অনুভব করতাম না। যেন অন্য কারো গল্প বলছি, অনুভূতির সাথে যাবতীয় সংযোগ বিচ্ছিন্ন। বেদনাদায়ক স্মৃতি বা আত্মঘাতী চিন্তাভাবনার ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করতাম ঠিকই, কিন্তু সেগুলো কোন প্রভাব ফেলতে না আমার মানসচিত্তে।